ইন্তিরি বিন্তিরি আর তিন্তিরিদের সভা বসে রোজ বিকেলবেলা, টুলুদের বাড়ির পেছনে চৌবাচ্চার পাশে। জায়গাটা ভারি নিরিবিলি। এদিকে কেউেই আসে না।কাজের লোকদের মাজাঘষা শেষ হয়ে যায়। টুলুরা খেলতে চলে যায়।বাড়ির সকলেই সামনের দিকে থাকে। তখন ইন্তিরি বিন্তিরি তিন্তিরি একত্রে এসে জোটে, নানা সুখ দুঃখের কথা বলে।
সেদিনও এমনি বিকেল হয়ে এসেছে।সূর্যের হলদে আলো ঝিলমিল করছে। খানিক আগে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে এখন বৃষ্টি ধোওয়া আকাশে হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বিকেলটা হয়েছে তাই ভারি মনোরম!
চৌবাচ্চার ড্রেনের পাশ দিয়ে বিন্তিরি বেরিয়ে এল। এদিক ওদিক সুড়সুড় করে ঘুরে বেড়ালো, ইন্তিরি আর তিন্তিরির কারুর নেই। বিন্তিরি তখন চৌবাচ্চার পাশে কলতলায় এসে হাজির হল। এঁটো বাসনকোসন থেকে ফেলে দেওয়া খাবারগুলো খেয়ে নিল।
আর, ঠিক তখনি শুনতে পেল টিক টিক টিক, তরতর করে দেয়াল বেয়ে তিন্তিরি নেমে এল।
এসে বলল, কী ভায়া, এসেই যে খেতে শুরু করলে?
বিন্তিরি বলল, আর বলিস নে ভাই, কতদিন যে পেট পুরে খেতে পাই নে।
কেন, সকলের ভাঁড়ার ঘরের দরজা রাত্রিবেলা তোমার জন্যেই তো খোলা থাকে।
সেদিন আর নেই রে ভাই, দিনকাল যা হয়েছে, তাতে ছেলেপুলে নিয়ে বেঁচে থাকা বড় সহজ নয়।
এমন সময় পাশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল ইন্তিরি। বলল, ভাই যা বলেছ, তোমাদের তো তবু খাওয়া পরার কষ্ট। আমাদের যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি।
ইন্তিরি ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তাই বুঝি তুমি ঝোপের আড়ালে লুকিয়েছিলে।
আমরা বলি ইন্তিরি গেল কোথায়?
ইন্তিরি চটে উঠে বলল, তুমি তো হাসবেই। আমার দশা হলে তোমার মুখে হাসি ফুটত না।
বিন্তিরি বলল, ব্যাপার কী ভাই, খুলে বলো না।
বলছি শোনো। মানুষের ছেলেরা আজকাল বায়োলজি পড়ছে কিনা,
বাধা দিয়ে বিন্তিরি বলে, বায়োলজি একরকম খাবার বুঝি? খাবার আবার পড়া লাগে নাকি?
আরে না না, খাবার নয়। একদিন ওরা ডাক্তার হবে, মানুষ কাটা ছেঁড়া শিখবে। তা্ই এখন ব্যাঙ কেটে পাকাপোক্ত হচ্ছে।
মানুষ কাটা শিখবে, তো এখন থেকেই মানুষ কেটে শেখে না কেন?
জ্যান্ত মানুষ না কাটলে মানুষ কাটা শিখবে কী করে?
কেন, সরা মানুষ কেটে। কিন্তু সে তো পরের কথা, এখন ওরা ঝোপেঝাড়ে, বাড়ির আনোচেকানাচে ব্যাঙ খুঁজে বেড়াচ্ছে, পেলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
বিন্তিরি তার গোঁফ নেড়ে লম্বা লেজ দুলিয়ে বলল, তাহলে তোমার তো ভারি বিপদ।
বিপদ বলে বিপদ। হতাশ কণ্ঠে বলে ইন্তিরি, এই তো সেদিন বড় মামার ছেলে খাবারের খোঁজে যেই বেড়িয়েছে অমনি তাকে খপ করে ধরে নিল ও বাড়ির ছেলেটা। মামা মামির সেকি কান্না।বড় ফুফুর ননদেরও দুটো ছেলে উধাও।চাচি আম্মার ছোট ভাই আর বোনটি, তারাও পড়েছে মানুষের খপ্পরে। কতো আর বলবো বল।
তিন্তিরি বলল, না তোমাদের নিয়ে আর পারা গেল না। আরে বাপু, সংসারে দুঃখ আর বিপদ তো থাকবেই।
বাধা দিয়ে বিন্তিরি বলল, তোমার কী, দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াবে, পোকামাকড় ধরে ধরে খাবে। বিপদের আঁচড়টুকুও লাগবার ভয় নেই।
তিন্তিরি বড় করুন স্বরে বলল, না ভাই, তোমরা যা ভাবো, সত্যি তা নয়। দুঃখ আমারও আছে। এই দেখো না, সেদিন জানালার পাল্লা বন্ধ করতে গিয়ে আমার ছোট ভাইয়ের লেজ একজন দিল কেটে। পরশুদিন আমার বড়মামা তো মারাই গেল দরজার ফাঁকে পড়ে মাথা থেঁৎলে।
বিন্তিরি বলল সত্যি এরকম দুঃখকষ্ট তো আমাদের লেগেই আছে। তাছাড়া জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে উপোষ করে আধপেট খেয়ে বাঁচব কদিন আর বলো। জিনিষপত্র হাট থেকে কিনবার বালাই তো তোমার নেই, এবাড়ি ওবাড়ির ভাঁড়ার সাবার করলেই হল। আরে বাপু, ভাঁড়ার তো থাকলে সাবার করব। সকলে চড়া দামে জিনিস কেনে, তাই জাল দেয়া আলমারিতে বন্ধ করে রাখে।খাবারের কণাটুকু আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ইন্তিরি বলল, মানুষগুলো বড় স্বার্থপর। তিন্তিরি বলল, ওদের আর দোষ কি, চড়া দামে জিনিস কিনে সাবধান না হয়ে পারে বলো?
বিন্তিরি বলে, যাই বলো না কেন ভায়া, মানুষগুলো বড় একচোখা।
ভুস করে সেখানে লাফিয়ে পড়লো গঙ্গাফড়িং টিং টিং। এসে্ই খানিকটা নর্দমার পানি ঢকঢক খেয়ে নিয়ে একটা আরামের নিঃশ্বাস ছাড়ল, তারপর বলল, আঃ! বাঁচা গেল গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়েছিল।
ওরা তিনজনে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল এতক্ষণ ওর কাণ্ড দেখে। বিন্তিরি বলল, তুমি এলে কোথা থেকে বাপু, আকাশ ফুঁড়ে নাকি?
কেন আকাশ ফুঁড়ে কেন? তালগাছের মাথা থেকে। তবে আকাশকে নিয়ে এতক্ষণ গবেষণা চালাচ্ছিলাম।ইন্তিরি বলল,
তুমি দেখি আবার মানুষের মতো কথাবার্তা শুরু করলে।
করব না কেন, মানুষেরা প্রাণী, আমরাও প্রাণী। মানুষের চেয়ে আমরা বা কম কিসে? বাধা দিয়ে বিন্তিরি বলল, হয়েছে হয়েছে, এখন বলো আকাশকে নিয়ে কী গবেষণা করছিলে?।
ঐ তালগাছটার মাথায় চড়ে বাইনোকুলার লাগিয়ে তারা দেখছিলাম।
তিন্তিরি ফিক করে হেসে ফেলল। টিংটিং বলল, হাসলে যে বড়?
তিন্তিরি বলে, হাসব না? ওখানে তালগাছ কোথায় পেলে?
কেন দেখতে পাচ্ছো না, এ যে তালগাছের চুড়ো দেখা যাচ্ছে।
ওটা তাল গাছ নয়, পামগাছ, বিজ্ঞের মতো বলে তিন্তিরি।
পামগাছ সে আবার কিরে বাবা! ওটাতে কি পাম ফল ধরে?
ধ্যেৎ, পামগাছে আবার ফল ধরে নাকি?
তিন্তিরি হেসেই বাঁচে না। বিন্তিরি বলল, ভায়া, শুধু কি আকাশের তারা গুনলেই চলে, গাছ-গাছড়ার খবরও এক আধটু রাখতে হয়।
কেন, গাছগাছরার খবর রাখতে যাব কেন? আমি কি বোটানির ছাত্র?প্রশ্ন করে টিং টিং।
জেনে আমার কাজ নেই। আমার মতো তোমরা গাছের চুড়োতে চড়তে পারবে না, আকাশের তারাও গুনতে পারবে না।
আবার তাল গাছ? বলছি না ওটা পামগাছ।তিন্তিরি চেঁচিয়ে ওঠে।
টিং টিং বলে, আচ্ছা না হয় মানলাম ওটা পামগাছ। কিন্তু অমন বিদঘুটে নামওয়ালা গাছটা এল কোথা থেকে?
বিলেত থেকে। সবজান্তার মতো তিন্তিরি বলে।
তাই বলো। বিদেশী বলে্ই অমন বিদঘুটে নাম।কিন্তু এই গাছ এদেশে এল কী করে?
সাহেবেরা আমদানি করেছে। বিলেতি গাছ কিনা, তাই এর কদরও বেশি।
যেই গাছে ফল ধরে না, সেই গাছের আবার কদর কিসের?
তাও জানো না, ও যে শখের জিনিস। সৌখিন লোকদের বাড়ির সামনে লাগারো হয়।
ভেংচি কেটে টিং টিং বলে লোকের শখের নিকুচি।
বিন্তিরি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, তোমার অত রাগের কারণ কি বাপু! ঐ পামগাছ আছে বলেই তো তুমি গ্রহ
নক্ষত্র নিয়ে একসপেরিমেন্ট করতে পারছ।
তা সত্যি, বলে টিং টিং। ধারে কাছে অমন উচুঁ গাছ নজরে পড়ে না।
তিন্তিরি বলে, গাছ না থাকুক, ডিআইটি বিল্ডিং তো রয়েছে।
রয়েছে তো কী হয়েছে।দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়ানো, কার্নিস থেকে ছাদ, ছাদ থেকে কার্নিস, ওসব তোমার কাজ, আমাদের নয়!
বিন্তিরি বলে সত্যি, অত উপরে তুমি কি উঠতে পারবে?
বেড়ে বলেছ, আমি পারবো না, তুমি পারবে, কত উচুঁ শুনি?
পামগাছের মতো দুটো পামগাছ লাগালে এর সমান হয় কিনা সন্দেহ আছে।
তাহলে বেশ হয়, এর ছাদে উঠতে পারলে গবেষণার খুব সুবিধে হত। কিন্ত মানুষ নামের জীবগুলো ওখানে থাকে, তাদের কাছ ঘেঁসতে আমার প্রবৃত্তি হয় না।
ইন্তিরি এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার মুখ খুলল। বলল, সত্যি বলেছ ভাই, ঐ মানুষগুলোর জ্বালায় প্রাণ আমাদের অতিষ্ঠ হয় উঠেছে।বিন্তিরি বলে আমাদের কোন উপকারটা ওরা করছে শুনি, ওদের সব কাজে আমাদের প্রয়োজন। ইদুঁর নিয়ে, ব্যাঙ নিয়ে, টিকটিকি, পোকামাকড় নিয়ে ওরা গবেষণা চালায়। বড় বড় খেতাব পায়, দেশ-বিদেশে তাদের নাম-ডাক কত!
তিন্তিরি বলে শুধু কি তাই, জন্তু জানোয়ার না হলে তাদের এক পাও চলে না। দেখো না, মহাশূন্যে ইদুঁর পাঠাচ্ছে, কুকুরবেড়াল পাঠাচ্ছে।সমস্ত ধকল যাচ্ছে তাদের ওপর দিয়ে।কিন্তু বাহাদুরিটা ষোল আনা মানুষেরই। সফল হলে তখন মানুষ নিজেরা রওয়ানা হয়, তার আগে নয়।
বিন্তিরি বলে ভাবখানা দেখো না, ঢাকঢোল পিটিয়ে বাহাদুরি নেওয়ার কী হিড়িক, কাগজে কাগজে ফটো ছাপা হচ্ছে। খবর ছাপা হচ্ছে, প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে। কই আমাদের বেলা তো তা করে না। তাদের স্বার্থে কত প্রাণী প্রাণ দিল, তার জন্যে না আছে একটু দুঃখ, না আছে সহানুভূতি।
ইন্তিরি বলল সত্যি বলেছিস ভাই, বিন্তিরি।
টিংটিং বলে, সবুর করো বাপু তোমরা আর কটা দিন, বিজ্ঞানের টুকিটাকি আরো একটু আয়ত্ব করে নি।
তিন্তিরি বলে, কী করবে তাহলে?
মানুষের সব জারিজুরি ভেঙে দেব। বলে ফরফর করে উড়ে চলল টিং টিং।
বিন্তিরি তাকে ডেকে বলল, কোথায় চললে ভায়া, তারা গুনতে নাকি? কে কার কথা শোনে, টিং টিং ততক্ষণে উধাও।
ইন্তিরি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যাক বাঁচা গেল। কী ধাপ্পবাজের পাল্লায় পড়েছিলাম বাবা। দিনের বেলা বুঝি তারা দেখা যায়!