দ্বিতীয় পর্ব
‘কেউ যদি তোমকে বলে
আমাদের প্রেম হচ্ছে অসাধারণ
কারণ অসাধারণ পরিস্থিতিতে তার জন্ম
তো ওদের বলে দিও
আমরা ঠিক সেই উদ্দেশ্যেই লড়ছি
যাতে আমাদের প্রেম
একদমই সাদাসিধা আর সাধারণ হয়ে ওঠে
এল সালভেদরে
এটাই হল ভালবাসার রেয়াজ।’
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশেষ বিষয়ের যুগ্ম সচিব ( নিরাপত্তা) নাজনীন খোন্দকার গতকাল এসে পৌঁছেছেন খাগড়াছড়িতে। ছোট্ট হ্যালিপ্যাডে তাকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন স্থানীয় সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তারা। খাগড়াছড়ির সরকারি বাংলোতে পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে বিকেল বেলা লনে বসে চা খাচ্ছিলেন নাজনীন খোন্দকার।
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে। বর্তমানে চলছে যুদ্ধ বিরতি। ঢাকার সরকার চাচ্ছেন একটা সমঝোতায় আসতে। সরকারি মহল এখন মনে করছেন ভূমি জরিপের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা এবং বিশেষ করে ভূমি সমস্যার একটা সমাধান সম্ভবপর হবে। ১৯৯৩ সালেই সরকার ভূমি- জরিপের বিষয়ে একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পাহাড়ীরা এ ধরনের জরিপের বিরোধিতা করে আসছে। কারণ হাজার হাজার পাহাড়ী এখন শরণার্থী হিসেবে ভারতে রয়েছে। আর তাই পাহাড়ী জনতা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে, যত দিন না ভারতে আশ্রিত শরণার্থী নিজের জমিতে পুর্নবাসিত হয় এবং পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ীরা নিজেদের জমিতে বসবাস আরম্ভ করে ততদিন ভূমি জরিপ বন্ধ রাখতে হবে। ভূমি জরিপ আবার শুরু করা যায় কি’না সে ব্যাপারে আলাপ- আলোচনা করতেই নাজনীন খোন্দকারের খাগড়াছড়িতে আগমন। নাজনীনের ভাবনায় বাধা পড়ে। খাগড়াছড়ির চীফ প্রটোকল অফিসার ইকবাল হাসান লনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,
- ‘ম্যাডাম আপনার রাতের খাবারের মেন্যুটি বাবুর্চিকে বলতে হবে। যদি স্পেশাল কিছু খেতে চান তো বলেন।’
-‘রাতে আমি রুটি খাই, সঙ্গে ভাজি আর মুরগির কারি বলবেন।’
অর্ডার নিয়েই ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন। নাজনীন তাকে পিছু ডাক দিলেন। শুনুন, আপনার নাম আর ডেজিগনেশনটি বলবেন কি?
-‘আমি ইকবাল হাসান, খাগড়াছড়ির চীফ প্রটোকল অফিসার। সরকার, সেনাবাহিনী আর শান্তিবাহিনীর মধ্যে লিঁয়াজোর ভূমিকা পালন করতে হয় আমাকে।’
-‘তাই বলেন! আপনাকেই তো আমার প্রথম দরকার।
আগামীকাল আপনার সঙ্গে ডিটেল আলাপ হবে। আচ্ছা আপনি এখন যান। কাল সকাল সকাল চলে আসবেন।
ইকবাল হাসান – নামটি নাজনিনের খুব চেনা। ভদ্র লোকের চেহারা একটুও পাল্টায়নি। তবে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন। সারা মুখে অসম্ভব ক্লান্তির ছাপ মাখা। আশ্চর্য ব্যাপার হাসান তাকে চিনতে পর্যন্ত পারলো না! না’কি চিনেও না চেনার ভাণ করলো। বেশী দিন আগের কথা তো নয়। ১৯৮৩ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় হাসানের সঙ্গে নাজনীনের দেখা হয়। ১৪ ফেব্রæয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঘেরাও করে শিক্ষা ভবন। সেখানে পুলিশের সঙ্গে প্রচÐ সংঘর্ষ বেঁধে যায়। ১৫ ফেব্রæয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সক্রিয় নেত্রী হিসেবে নাজনীনকে এসবি’র লোক রোকেয়া হলের সামনে থেকে গ্রেফতার করে। ১৭ ফেব্রæয়ারি নাজনীকে চট্টগ্রামকে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদিকে চট্টগ্রামে ১৪ দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্থানীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ, সিটি কলেজ, সরকারী বাণিজ্য কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিডিট আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা অনুষ্ঠান ও মিছিল বের করে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ বেধে যায়। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে.... রক্তে ভিজে যায় রাজপথ। নিহত হয় মোজাম্মেল হক সহ কয়েকজন ছাত্র। উত্তপ্ত চট্টগ্রাম বন্দর নগরীতে নাজনীনকে নিয়ে এসে স্পেশাল ব্যাঞ্চের সদস্যরা ঝামেলাতেই পড়ে যায়। রাত তখন প্রায় ৯টা বাজে। সমগ্র চট্টগ্রামে সান্ধ্য আইন জারি রয়েছে তখন। আন্দর কিল্লার এক স্কুল মাস্টার ইকবাল হাসানের জিম্মায় নাজনীনকে রেখে যায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা। বাড়ির বাইরে দুজন পুলিশ রেখে যায় তারা পাহারা দেবার জন্যে।
নাজনীনকে দেখে একটু থতমত খেয়ে যায় হাসান। আসলে সে সবসময় ঝামেলামুক্ত থাকতে চায়। কিন্তু সব ঝামেলাই কেমন করে জানি হাসানের কাঁধে এসে পড়ে, তা সে বুঝতে পারে না।
ঘরের মিটি মিটি আলোয় মেয়েটিকে রহস্যময় লাগে হাসানের। মেয়েটিই প্রথম কথা বলে, ‘ আপনি কি বোকা না’কি?
থতমত খেয়ে যায় হাসান। কি বলতে চায় মেয়েটি!
মেয়েটি আবার বলে পুলিশের সঙ্গে কিসের বন্ধুত্ব আপনার? তারপরেই নাজনীনের মনে পড়ে নানান ভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চ না’কি বিভিন্ন জায়গায় তাদের ইনফরমার রাখে। তারমানে এই লোকটিও একজন ইনফরমার। কিন্তু দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না।
‘আমার ক্ষিধে লেগেছে। খেতে দিন।’
খা, খাবেন? লোকটি একটু তোতলে যায়।
একলা থাকে হাসান। ঘরে খাবারের আয়োজন নেই বললেই চলে। বেশীর ভাগ দিনই খাওয়ার পর্বটি সে হোটেলেই চুকিয়ে ফেলে। পুলিশের ইনফরমার হিসেবে মাসে যৎসামান্য যা পায় তাও তো দেশেই মায়ের কাছে পাঠাতে হয়।
- আরে বাবা, কি এতো ভাবছেন হাবার মতো? মেয়েটি ধমক লাগায় হাসানকে। এবার হাসান কিছুটা যেন নিজেকে সামলে নেয়। বলে ঘরে মুড়ি আর মোয়া ছাড়া কিছুই নেই। একরাতের ব্যাপার তো ঐ খেয়েই শুয়ে পড়–ন। সকাল হলে পুলিশের লোক এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।
মুড়ি- মোয়া খেতে খেতে নাজনীন হাসানের সঙ্গে রাজ্যের কথা আরম্ভ করে।
-এই দেশকে ভালোবাসেন আপনি?
-তা’ জেনে আপনার কি দরকার? বিরক্ত হয় হাসান।
‘ আরে সাহেব আপনি আমার ওপর রেগে যাচ্ছেন কেন? নাজনীন বলে। জানেন কেউ আমার ওপর রাগ দেখালে তাকে আমার ভীষণ চড়াতে ইচ্ছা করে। নাজনীনের কথায় হাসান আবারও অবাক হয়। ভাবে রাত দুপুরে কি এক উটকো ঝালেমায় পড়লাম রে বাবা!
- শুনুন আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে ঘরে চাল ডাল কি আছে দিন আমি নিজেই রেঁধে খাবো। আপনার তো মনে হয় রাত না খেলেও চলে। না’ কি থানায় দু‘টা মেরে এসেছেন ও.সি’র সঙ্গে। আপনার তো আবার ওপরতলার লোকদের সঙ্গে উঠবস।
- নাজনীনের খোঁচাটা হজম করে নিয়ে হাসান বলে, ঘরে চাল ডাল সবই আছে হেল্প ইয়র সেল্প, নিজে রেধেঁ খেতে পারেন।
- চমৎকার, এটাই তো চাচ্ছিলাম। নাজনীন নিজেই এবার রান্নার কাজে তৎপর হয়।
- ম্যাডাম আপনার চা । বেয়ারা চা নিয়ে এসে, যুগ্ম সচিব নাজনিনকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নাজনিন আপন মনেই হাসে। সেদিন রাতে হাসানকে সে খিঁচুরী খাইয়েছিল। হাসানের সঙ্গে তার ভালো বন্ধুত্বও হয়েছিল। কিন্তু হাসান যখন তাকে বলেছিল, আপনি খুব সুন্দর দেখতে। তখন নাজনীন বেশ রেগে গিয়েছিল। বলেছিল, কোতয়ালি থানার ওসিও আমার রূপ যৌবন নিয়ে রসালো কথা বলেছে। আপনাদের পুরূষদের এ ধরনের হেংলামো কথা আমি এদম পছন্দ করি না। ওসিকে তো পায়ের সেন্ডেল দিয়ে মারতে ইচ্ছা হচ্ছিল। তবে আপনার বলার ভঙ্গী আর মনোভাব অন্য রকম বলে ক্ষমা করে দিলাম।
- রাত ক্রমে গভীর হয়েছিল। নাজনীন বোধ হয় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ হাসানের ডাকে তার ঘুম ভাঙে। গলার স্বর খুব নীচে নামিয়ে নাজনীনকে হাসান বলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন। আপনার পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি। আনন্দর কিল্লার পেছনের এই রাস্তা দিয়ে পুলিশের চোখ এড়িয়ে আপনাকে বান্দরবনে পাঠিয়ে দিব। সেখানে মৃম্ময়ী চাকমার কাছে কিছু দিন থাকবেন। তারপর আপনার পথ আপনাকেই বেছে নিতে হবে।
- তখনও ভোর হয়নি। আকাশ সবে ফর্সা হতে আরম্ভ করেছে। দুরের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজান ভেসে আসছে। সকাল হবার সেই আলো– আধাঁরের মাঝে হাসানকে কেন জানি খুব অন্যরকম লাগে নাজনীনের। ভীষণ ভালোলাগে মানুষটাকে। কিন্তু কিছুই আর বলা হয় না। তবু অপেক্ষমান জিপ গাড়িতে ওঠার সময় নাজনীন একটা ছেলেমানুষী প্রশ্ন করে বসে। আমার কথা আপনার মনে থাকবে তো? হাসান ঊত্তরে বলেছিল, মনে আমার ঠিকই থাকবে। তবে আপনারই মনে থাকবে না।........
সকালবেলা নাস্তা খাবার পর যুগ্ম সচিব নাচনীন খোন্দকার ইজিচেয়রে বসে চা খাচ্ছিলেন। হাসানের পায়ের শব্দে ফিরে চাইলেন। পরক্ষণেই ঘুমহীন রাতটার কথা মনে হলো। দিনের আলোয় এতো বছর পড়ে দেখা মানুষটাকে তার একেবারেই অচেনা লাগলো। মাত্র একটা রাতের পরিচয় । অথচ লোকটা তার মনের কতখানি জুড়েছিল। এ কটা বছর নাজনীন তা ভাবতেও পারেনি। তার অলক্ষ্যে মনের গভীর কোণে হাসান একটা স্থান করে নিয়েছিল। খাগড়াছড়িতে না আসলে এ ব্যপারটা নাজনীন কোন দিনই হয়ত বুঝতো না। (চলবে)
[ধারাবাহিক উপন্যাস ‘দুই নগরের উপাখ্যান ’ রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। উপন্যাসের চরিত্রসমূহ কাল্পনিক। কোন জীবিত বা মৃত মানুষের জীবনের সাথে এর কোন সাদৃস্য পাওয়া যাবে না। পটভূমি ঐতিহাসিক হওয়াতে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাসের সঙ্গে হুবহু মিল নাও পাওয়া যেতে পারে।]