সাম্প্রতিক প্রকাশনা

চকরিয়ার বনদেবী

আলতামাস পাশা লেখাটি পড়েছেন 1826 জন পাঠক।
 মনটা কিছুদিন থেকেই ভার ভার লাগছিল। চাকরিতে একঘেঁয়েমী  আসা যাকে বলে তাই আমাকে পেয়ে বসেছিলো। বন বিভাগের চাকরিতে একটি রোমাঞ্চ থাকে সব সময়ই। কিন্তু চোরাই কাঠ পাচারকারীদের পিছু ঘুরতে ঘুরতে মেজাজটা আমার একেবারে খিঁচরে গিয়েছিলো গত ছ’মাসে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চকরিয়া সুন্দরবনে বদলি হয়ে প্রথমদিকে দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো। বন বিভাগের বাংলোতে থাকা খাওয়া সে এক রাজকীয় ব্যাপার। অতি অল্পদিনেই আমি ভুলে গিয়েছিলাম পাবর্ত্য বনে সেই বুনো শুয়োর তাড়া করার চরম ভোগান্তির কথা। 

ঘটনার গভীরে যাওয়ার আগে পাঠককে আমার পরিচয়টা একটু দিয়ে নিচ্ছি। আমি সেলিম- সেলিম চৌধূরী। বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগে কাজ করি। বর্তমানে সহকারী রেঞ্জারের কাজ করি। কোনো পিছুটান না থাকায় শিকার করা আর অ্যাডভেনচারের প্রতি আমার ভার্সিটি লাইফ থেকেই বিপুল উৎসাহ। দুরন্ত নিঃসঙ্গ প্রকৃতির সবুজ প্রান্তরে- জন্তুজানোয়ার পাখির অদ্ভুত আশ্চর্য জগতে। মানুষের সভ্যজগত থেকে বনের জগৎ আমার সব সময়ই ভালো লেগেছে। কারণ বনের হিংস্র প্রাণীটিও অতি শান্ত মানুষটির চেয়ে বেশি নিরাপদ। বনবিভাগের চাকরি আমাকে অরণ্যের সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা গড়ে তুলতে আরও বেশি সাহায্য করেছে। সুন্দরবন নিজেই চিরসুন্দরী। এর রূপের কোরো সীমা নেই। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলের বেলাভূমিতে ও অভয়ারণ্য এলাকা অপূর্ব নৈসর্গমণ্ডিত। সুন্দরবনের বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির মুহূর্তেই আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। এখানকার নীলকমল, হিরণ পয়েন্ট, টাইগার পয়েন্ট, কিংবা কটকা অথবা অভয়ারণ্য প্রভৃতি স্থানে যেতে বন বিভাগের অনুমতি লাগে। অবৈধ শিকারিরা যাতে প্রাণী হত্যা করতে না পারে তাই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবু নানাভাবে অবৈধ শিকারি আর কাঠপাচারকারীরা এ এলাকায় ঢুকে পড়ে। এসব এলাকায় তাই মাঝে মধ্যেই আমাকে রাউন্ডে যেতে হয়।

এখন শীতকাল। নভেম্বর মাস শেষ হয়ে ডিসেম্বরের প্রহম সপ্তাহ চলছে। সকাল  বেলাটা এদিকে বেশ কুয়াশা পড়ে। আমি ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বন বিভাগের বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ঘন কুয়াশায় চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রশিদ মিয়ার আজ আসার কথা হিরণ পয়েন্ট থেকে। সেখানে বিনা অনুমতিতে কারা যেন হরিণ শিকার করেছে। বিস্তারিক জানতে রশিদকে দু’জন ফরেস্ট গার্ডসহ পাঠানো হয়েছে। আমিও ভাবছিলাম স্পট অনুসন্ধানে যাবো। কারণ হিরণ পয়েন্টে নদীর চরে কুমির আর হাঙ্গর দেখতে পাওয়া যায়। কুমিরের চামড়ার ব্যবসা বেশ লাভজনক। অবৈধ শিকারীদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হিরণ পয়েন্টে আমাকে যেতেই হবে। এখন অপেক্ষা শুধু রশিদের জন্য।

আবার চলেছি সুন্দরবনে। আমার কাছে সুন্দরবন একটি চমৎকার জায়গা। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ ভূ-খণ্ড জুড়ে বিস্তৃত দুর্গম অরণ্য সুন্দরবন আমার মতো  ঘরছাড়া মানুষের জন্য চিররহস্যময় জায়গা। সারা বনাঞ্চল জুড়ে মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির দেয়াল আর অথৈ পানির নিত্য জোয়ারভাঁটার খেলা চলে এখানে। খুলনা বন বিভাগের মাইক্রোবাসে করে আমরা চারজন রওয়ানা হয়েছি। আমি আর রশিদ ছাড়াও ফরেষ্ট গার্ডও সঙ্গে রয়েছে। দিন থাকতে থাকতেই আমাদের পৌঁছতে হবে। 

হিরণ পয়েন্টের আরেক নাম হচ্ছে ‘নীলকমল’। নীলকমল নামটি শুনলেই আমার ছেলেবেলার কথা মনে হয়। মা ঠাকুরমা’র ঝুলি থেকে এ গল্পটি আমাকে বলতেন তখন হয়তো বেশ রাত। বাবা সংবাদপত্র অফিসে কাজ করতেন। তার ফিরতে রাত হত। আমি কিছুতেই ভাত খেতে চাইতাম না বাবাকে ছাড়া। তখন মা আমাকে খাইয়ে দিয়ে নীল কমল আর লাল কমলের গল্প শুনিয়ে ঘূম পাড়াতেন। হিরণ পয়েন্টে এলে তাই আমাকে ছেলেমানুষীতে পেয়ে বসে।

হরিণ শিকারিদলের সন্ধান মিলেছে গতকাল। বেশ প্রভাবশালী লোক। নাম শিহাব সরদার। সন্দেহ হয় সুন্দরবন এলাকার জলদস্যুদের সঙ্গে তার হাত আছে। সুন্দরবন এলাকার নিকটবর্তী লোকালয় আর বনাঞ্চল বেশ অনেকদিন থেকেই সন্ত্রাসী তৎপরতায় জিম্মি হয়ে আছে। দুর্ধষ এসব দস্যু সুন্দরবনসংলগ্ন বেশ কয়েকটি জনবসতি এলাকার গৃহপালিত পশু নিয়ে যায় আর বড় বড় গাছ কেটে নৌপথে পাচার করে দেয়। শিহাব সরদারের নাকি আলাদা বাহিনীও আছে। এ বাহিনীর নাম জানা গেছে ‘বাদল পেয়াদা বাহিনী’। আমরা বন বিভাগের অফিসে উঠেছি। চারপাশটা গাছগাছালিতে ভরা। শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশে হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। গাছের ডালে ডালে বানরদের দৃষ্টিকারা ছেলেমানুষী খেলা। অথচ মানুষগুলো পশুর চেয়েও হিংস্র আর বর্বর। আমি দীর্ঘদিন বনে জঙ্গলে কাটিয়েছি। আমার অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি তাহল খুব হিংস্র প্রাণীটিও ভয়ংকর বিপদে না পড়লে কখনো মানুষ বা অন্য প্রাণীকে মারে না। অথচ আমরা?

 রশিদ মিয়া একটু আগে জানিয়ে গেল বাদল পেয়াদা বাহিনীকে সর্বশেষ দেখা গেছে দুবলা চরে। সতর্ক হলাম। কারণ চর সংলগ্ন বনেই চিত্রা হরিণের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। হরিণ শিকারে পেয়াদা বাহিনীর জুরি মেলা ভার। তাই খুলনা জেলা প্রশাসনকে লঞ্চসহ আমর্স পুলিশ ব্যাটেলিয়ন পাঠাবার ওয়ারলেস ম্যাসেজ পাঠিয়ে বনবিভাগের বারান্দায় এসে বসলাম। মনে পড়লো ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত  দুবলা চর জেলেরা মুখরিত করে রাখে। প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার জেলে এ চরে তিন মাস ধরে বাস করে। সারাদিন তারা সাগরবুকে মাছ ধরে সন্ধ্যায় ফিরে আসে জেলে পল্লীতে। রাস পূর্ণিমায় সাগর স্নান উপলক্ষে প্রতি বছর এ চরে হাজার হাজার হিন্দু পূণ্যার্থীর সমাগম ঘটে। তখন এখানে মেলা বসতেও দেখা যায়।  ‘দুবলা চরের মেলা’ নামে এ মেলার খ্যাতিও রয়েছে।

দুবলা চরের কাজ শেষ। গতকাল হিরণ পয়েন্ট থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু কোনো কাজে মন বসছে না। কেমন জানি অস্থির  অস্থির লাগছে। সারাক্ষণ। দুপুরের মধ্যেই অস্থিরতা কারণও খুঁজে পেলাম। কটকা আর টাইগার পয়েন্টে মানুষখেকো বাঘের সন্ধান মিলেছে। তবে বাঘটি এখনো কেউ দেখতে পায়নি। স্থানীয় পাঁচজন বাওয়ালী প্রাণ  হারিয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই দেহাবশেষ ছিল আধ খাওয়া অবস্থায়। অতত্রব আমার ডাক পড়লো সেখানে। রশিদ মিয়াকে তৈরি হতে বললাম। আগামীকাল খুব সকালেই আমরা কটকা রওয়ানা হব। শরণখোলা থেকে কটকার দূরত্ব প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। বন বিভাগের রেস্ট হাউজ আছে এখানে। রেস্ট হাউজের মাইল দুয়েক সামনেই ঘন অরণ্য।

আজ সকাল থেকেই ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এক আকাশ মেঘ থেকে ঝরেই চলেছে। এরকম বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বেরোতে মোটেই ইচ্ছে হচ্ছিলো না। বিছানায় শুয়ে কাটালাম সারাটা দিন। এখন বিকেল হয়ে গেছে। জানালার বাইরে মরা আলো। বাঘটার কথা ভাবছিলাম। বাঘ সাধারণত লোকালয়ে  মানুষ আক্রমণ করে আহত বা বৃদ্ধ হয়ে পড়লে। এ বাঘটির মানুষখেকো হবার কারণ কি তা জানা দরকার। ঠিক করলাম আগামীকাল বৃষ্টি না হলে আমরা টাইগার পয়েন্টের জঙ্গলে প্রবেশ করবো। রশিদকে সেইমতো  নির্দেশ দিলাম।
টাইগার পয়েন্ট সুন্দরবনের সর্বাধিক বাঘ বিচরণক্ষেত্র। রশিদ মিয়া এ এলকার পুরোনো লোক। তার কাছে বাঘের বিচিত্র সব কাহিনী শুনতে শুনতে আজ সকালে আমি টাইগার পয়েন্ট জঙ্গলে প্রবেশ করেছি।

দিনের আলোয় কাজ করতে যেতেও ভয় পাচ্ছে আজকাল বাওয়ালীরা আর কাঠকুড়ানীরা। আমরা সাবধানে এগিয়ে চলেছি। ক্রমেই বন ঘন হয়ে আসছে। সূর্যের আলোও ম্লান হয়ে এসেছে সমস্ত বনজুড়ে। ক্যাম্প ফেলার যুৎসই জায়গা পাচ্ছি না। কাছেই জলাশয় আছে  এমন একটি জায়গা বের করতে বললাম রশিদকে। তাছাড়া প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে আমাদের প্রত্যেকেরই সুুতরাং যত শীঘ্র তাবু ফেলা যায় ততই মঙ্গল।

তাঁবু ফেলার জায়গা পেয়ে গেল রশিদ মিয়া। তিনধারে গভীর জঙ্গল। সামনেই একটি নদীর বাাঁকের মতো জলাশয়। জলাশয় থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে একটু থোলা জায়গা  পাওয়া গেল। এ জায়গাটির  অবস্থান  সত্যিই আশ্চর্যজনক। সাধারণত এ ধরনের গভীর জঙ্গলে খানিকটা খোলা জায়গা পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। জলাশয়ের ভেজা মাটি জন্তু-জানোয়ারের নিয়মিত আসার পদচিহ্ন ধরে রেখেছে পরম যত্নে।

রশিদ মিয়া এরই মধ্যে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছে। গরম গরম কফি আর টিনের মটরশুঁটি আমার হাতে ধরিয়ে দিল সে আধা ঘন্টার মধ্যেই। রাতের জন্য আলুর দম, রুটি আর মুরগির ভুনা মাংস করতে বলে আমি তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এবার সত্যি সত্যিই আমার গা কেমন যেন ছম ছম করে উঠলো। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি অতিপ্রাাকৃত ঘটনাগুলো আমার জীবনে বেশি বেশি করে ঘটে।

সুন্দরবনের এ এলাকায় গভীর জঙ্গলে উন্মুক্ত আকাশের নীচে এরকম খোলা জায়গা কখনো আর দেখা গিয়েছে কিনা তা আমি জানি না। তাই রশিদ মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। সে বেশ কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে অবশেষে যা বললো তার মর্মকথা হলো, ‘সবই আমাদের ভাগ্য স্যার। এ হল গিয়ে ঐ ব্যাটা বাওয়ালিদের পাপের শাস্তি। মৌমাছিরা কষ্ট করে মধু বানায় আর ঐ ব্যাটারা তা চুরি করে নিয়ে যায়। একবার রাত বেশি হয়ে যাওয়াতে বাওয়ালীরা পথ  হারিয়ে এখানে এসে পড়ে। বাঘের ভয়ে রাতে শুকনো ডালপালা একত্রে করে আগুন জ্বালায়। অসাবধানতার কারণে আগুন লেগে বনের এ অংশে তারা পুড়ে মরে। কিন্তু তাদের পোড়া শরীর বা ছাইও কেউ দেখতে পায়নি। স্থানীয় বাওয়ালীদের বক্তব্য হচ্ছে বনদেবতা রেগে গিয়ে তাদের ভস্ম করে দিয়েছে। আর বনের পবিত্রতা রক্ষায় এখানকার গাছগুলোও পুড়িয়ে দিয়েছে।

রশিদ মিয়ার কথা যদি সত্যি বলে ধরেনি তাহলে আমাদের কপালেও আজ রাতে দুঃখ আছে এটি বেশ বুঝতে পারছি। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে যদি ‘বনদেবতায়’ বিশ্বাস করি তাহলে আমাকে সবাই যে পাগল ভাববে তা-ও বেশ বুঝতে পারছি। অতত্রব তাঁবুর ভেতরে গিয়ে বাঘ বাবাজীর কি করা যায় তা ভাবতে লাগলাম।

রাতের খাবার তৈরি হয়ে গিয়েছিলো- তাই দেরি না করে খেয়ে নিলাম। এখন বেশ শীত পড়েছে। তাঁবুর সামনে ডালপালা দিয়ে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিবেশটা বেশ সুনসান এখন। বনদেবতার আগমনের কোনো লক্ষণ এখনো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যের ক্লান্তিতে আমার দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। রশিদকে বললাম, আমি ঘুমাতে চললাম তেমন কিছু  হলে ডাক দিও আর সাবধান থেকো। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখ ঘুমে বুঁজে এলো। ঘুমটা কি কারণে ভাঙলো তা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো। সমস্ত তাঁবু দুলছে। ভূমিকম্প? দ্রুত বাইরে বেরোতে গেলাম আর তখনি গগন কাঁপানো গর্জন শুনলাম বাঘের। আর সেই সঙ্গে গুলির আওয়াজ। নিঃশব্দে শরীরটাকে উল্টে দিয়ে আমার প্রিয় রাইফেলটা হাতে নিয়ে আসলাম। তাঁবুর বাইরে তখল হুলুস্থুল কাণ্ড। রশিদ মিয়ার স্থানীয় ভাষায় আহাজারী তীব্র হয়ে উঠার আগে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার হাত দুয়েক দূরে বনরক্ষী আজমল মাটিতে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। পাঁজরের কাছে মাংস হাড় সব বেরিয়ে এসেছে। রাগে দুঃখে আমার তখন অদ্ভুত অবস্থা। আমি থাকতে একটি বাঘ আমার বনরক্ষীকে মেরে রেখে গেল তাতো ভাবাই যায় না। রশিদ মিয়া যা জানালো তা হচ্ছে, মৃদু আর্ত চিৎকার আর ক্রুদ্ধ গর্জনে তার ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার তখন বেশ গাঢ় হয়েছে। আগুন নিভে এসেছে। চাঁদ গা ঢাকা দিয়েছে মেঘের আড়ালে মেঘের আড়ালে। অন্ধকারে বাঘের সেই চিরপরিচিত চোখদুটি চিনতে রশিদ মিয়ার এতটুকু ভুল হয়নি। রাইফেলে হাত রেখেই সে বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলো। এক সময় বাঘটি আমার তাঁবুর দিকে রওয়ানা হলে রশিদ মিয়া রাইফেল হাতে বেরিয়ে আসে এবং বাঘকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। রশিদ মিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস বাঘটি কাছাকাছি কোথাও মরে পরে আছে। ভোর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং রশিদ মিয়াকে বললাম মৃত বনরক্ষীর দেহের ব্যবস্থা করতে, ভোর হলে বাকি দু’জন বনরক্ষীর সহায়তায়  আজমলকে খুলনায় পাঠাতে।

সকাল হতেই রশিদ মিয়া ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে তাঁবুতে ঢুকলো। চা’টা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বেশ চিন্তান্বিতভাবে বললো, এখন আমরা মাত্র দু’জন থাকলাম। আমি ধমক দিয়ে বললাম, তাতে কি? আজ রাতটা থেকে আগামীকাল ফিরে যাব। আর বাঘটা সত্যি মরেছে কিনা সেটাও তো নিশ্চিত হতে হবে। তুমি তৈরি হও। আমি এখনই আসছি। সারাদিন গভীর জঙ্গলে অনেক অনুসন্ধান করেও বাঘের কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না। এমনকি বাঘটি আহত হয়ে থাকলে মাটিতে যে রক্তের দাগ থাকবে তারও কোনো চিহ্ন নেই। মজার ব্যাপার সারাটা বন জুড়ে অন্যকোন পশুপাখির চিহ্নও চোখে পড়লো না। রশিদ মিয়া বিষয়টি নিয়ে কি যেন বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু আমার ধমক খেয়ে শেষে চুপ করে গেল।

ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সন্ধ্যার একটু আগে আমরা তাঁবুতে ফিলে এসেছি। রশিদ মিয়া রাতের রান্নার যোগারে ব্যস্ত। হঠাৎ সন্ধ্যার আবছায়ার মধ্যে কতগুলো মানুষ আমাদের তাঁবুর সামনে যেন আকাশ থেকে নেমে এলো। রশিদ মিয়া চমকে উঠলো। সেই সাথে আমিও। পোশাক পরিচ্ছদ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এরা বাওয়ালী। কিন্তু এখানে হঠাৎ এলো কি করে? আর উদ্দেশ্যই বা কি? বাওয়ালীদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো, রাতটা এখানেই থাকবো। প্রচুর মধু সংগ্রহ হয়েছে আজ। আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না স্যার। আমরা ও পাশে নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা করে নিতে পারবো। 

নিজেদের রাতের খাবার বাওয়ালীরা বানিয়ে নিয়েছে। আমি কফি খেতে খেতে রশিদকে জিজ্ঞেস করলাম, হালচাল কেমন বুঝছো হে? রশিদ ফিসফিস করে বললো, বাওয়ালীদের ব্যাপার-স্যাপার ভালো নয়। কি যে রান্না করেছে বোঝা মুশকিল, উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে। ঠিক সে মুহূর্তেই বাওয়ালীদের হাকডাকে আমরা তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম। তাঁবুর বাইরে ডালপালা দিয়ে আমরা যে আগুন জ্বালিয়েছি বাওয়ালীরা তা নিভিয়ে ফেলতে বলছে। কারণ জিজ্ঞেস করতে জবাব এলো রাত্রি বারোটার পর এভাবে আগুন জ্বালিয়ে রাখলে না’কি বনদেবতা রুষ্ট হন। অতত্রব আগুন নিভিয়ে ফেলতে হবে। রশিদ মিয়া দেখলাম আমার নির্দেশের অপেক্ষা না করেই আগুন নিভিয়ে দিল।

চারপাশ এখন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। আকাশ বেশ পরিষ্কার। অগণিত তারা সেখানে জ্বলজ্বল করছে। প্রকৃতি যেন কিসের প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে। দূরে কোথাও রাত জাগা পাখির একটানা ডাক শোনা যাচ্ছে। নিজের অস্তিত্ব যেন সগৌরবে ঘোষণা করছে। রশিদ মিয়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। অবাক হয়ে দেখলাম বাওয়ালীরা কেমন যেন বিড়বিড় করে কিসব পড়ছে। বনের দিক থেকে কেমন একটি ঠান্ডা ঠান্ডা  বাতাস বইছে। এতো ঠান্ডা সে বাতাস যে দাঁড়িয়ে থেকে তা সহ্য করা যায় না। বাওয়ালীদের একজন তীক্ষ্ণ স্বরে যেন আমাদের জিজ্ঞেস করলো, সাহেব তোমরা কি বাঘ মেরেছো? 

রশিদ মিয়া বিড় বিড় করে কি যেন বললো।
উত্তর এলো, ব্যাটা আহম্মক গুলি করতে গেলি কেন? এখন মজা টের পাবি হাড়ে হাড়ে। মজাটা যে কি তা বুঝতে পারলাম মিনিট পনোরোর মধ্যেই।
বাওয়ালীগুলো চোখের নিমেশে কোথায় জানি হারিয়ে গেল। সারাটা আকাশ অদ্ভূত লাল রঙের মেঘে ছেয়ে গেল। প্রচন্ড হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাসে বাধ্য হয়ে তাঁবুর ভেতরে আশ্রয় নিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই। ঘুম যখন ভাঙলো মনে হলো আমি শূন্যে ভাসছি, না’ হয় অন্য কোনো ব্যাপার। ঠান্ডার জন্য কম্বল জড়িয়ে শুয়েছিলাম। এখনো সেভাবেই আছি। শূন্য দিয়ে ছুটে চলেছি শুধু। কেমন জানি সন্দেহ হল হাত দিয়ে চারপাশটা বোঝার চেষ্টা করতেই ঘন পশমের মধ্যে হাত ডুবে গেল। এ কে? আমাকে নিয়ে ছুটে চলেছে কোথায়? এ কি কোন প্রাণী না’কি কথিত সেই বন দেবতা।? শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে চিৎকার করে উঠলাম, বাঁচাও! বাঁচাও! পরমুহূর্তেই ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ তার উপস্থিতি ঘোষণা করে তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে নিকটবর্তী ঝোপে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর আর কিছুই মনে নেই।

ঠান্ডা পানির ঝাপটায় জ্ঞান ফিরে এলো আমার। মুখের সামনে শঙ্কিত ব্যাকুল রেঞ্জার সাহেব, সিভিল সার্জন আর রশিদের মুখ দেখে উল্টো আমারই বড্ডো মায়া হল। সেই সাথে বুঝতে পারলাম আর একটা ফাঁড়া কাটলো। এখনো সেলিম চৌধুরী বেঁচে বর্তে আছে। হয়তোবা থাকবেও বেশ কিছুদিন।

পাঠক, বনদেবতা অলীক কিছু নয়। প্রকৃতির বিপরীতে কাজ করতে গেলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ তো নেবেই। তবে রশিদ মিয়ার ধারণা বনদেবতা আমার ওপর প্রসন্ন থাকাতেই এ যাত্রা রক্ষা পাওয়া গেছে। তবে আমার ধারণা অন্যকিছু। অনেকদিন থেকেই আমি মনে মনে বিশ্বাস করি ভিনগ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যেও উপর নজর রেখে চলেছে। এই বাস্তুতন্ত্রে যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য মানুষের অগোচরে তারাও তৎপর রয়েছে তাদের সুপার টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে। কিছু ক্ষেত্রে তারা নিজেদের উপস্থিতি এভাবেই জানান দিয়ে যাচ্ছে। আমি চিন্তাশীল বলে, কুসংস্কারমুক্ত বলে আমার প্রতিটি অনুভূতিতে তা উপলদ্ধি করতে পারছি সচেতনভাবে। আমার সাথে যোগাযোগ অথবা সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটবে কি ভিনগ্রহের প্রাণীদের? এরা কি মানুষের আকৃতিরই হবে? না’কি অন্যরকম বা অন্য কিছু!

পাঠকের মন্তব্য


অন্যন্যা : খুবই ভালো !

একই ধরনের লেখা, আপনার পছন্দ হতে পারে

bdjogajog