ইয়েতি বা তুষার মানবকে নিয়ে আছে গা ছমছম করা নানা গল্প। হিমালয়ের এ রহস্যময় প্রাণীটিকে চোখে দেখা যায় না, দেখা যায় তার শুধু এর পায়ের ছাপ। ইয়েতি কি সত্যিই আছে? ইয়েতি নিয়ে রোমাঞ্চকর সব কাহিনী অনেক লেখা হয়েছে। তবে আসলেই কি এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা ভিত্তি নেই? না’কি ইয়েতি আসলে যতটা বাস্তবের, ঠিক ততটাই কল্পনার? রেনহোল্ড মেসনার সম্প্রতি তার গ্রন্থ ‘ মাই কোয়েস্ট ফর দ্য ইয়েতি’ তে এমন ধারনাই প্রকাশ করেছেন।
পশ্চিমী মিডিয়া ইয়েতি বলতে যে, ‘অ্যাবোমিনেবল ব্লো ম্যানের’ গল্প বলে তার সঙ্গে কিন্তু একেবারেই মিল নেই মেসনারের ধারনার। ‘মাই কোয়েস্ট ফর ইয়েতিতে মেসনার বারবার বলেছেন, তিব্বত ও নেপালের মানুষকে না বুঝলে, তাদের সমাজ- সংস্কৃতি-বিশ্বাসকে না বুঝলে ইয়েতিকে বোঝা সম্ভবপর নয়। বাস্তবের চেমো এবং কল্পনার ইয়েতির মধ্যে যে ব্যবধান, তার মধ্যে আসলে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের বিশাল বরফঢাকা ‘অ্যাস্ফি থিয়েটার’, অতলস্পর্শী খাদ, গভীর আলপাইন অরণ্য ও বিস্তীর্ণ পাথুরে জমি। তাই এমন মানববর্জিত নিসর্গই তো পারে কল্পনার জন্ম দিতে। যুগ যুগ ধরে এমন কল্পনার ্ওপর আরও কল্পনার আস্তরণ পরে হয়তোবা হারিয়ে গেছে মূল বিষয়টি। মানুষের কল্পনাই হয়ে উঠেছে বাস্তব। এভাবেই জন্ম নিয়েছে ইয়েতি কাহিনী।
ইয়েতি কি মানুষ আর বন মানুষের বিবর্তনের আদিরূপ? চার্লস ডারউইন যেমনটি বলেছিলেন যে, অন্যজাতের প্রাণী নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে মানুষ এর রূপ পেয়েছে। তবে কি ইয়েতি সেই আদিম রূপেই থেকে গেছে? হাজার হাজার বছরে তার কোনো বিবর্তন ঘটেনি? প্রকৃতির কোনো নিভৃত অঞ্চলে সে আজও বিচরণ করছে স্বাধীন ভাবে। মানুষের কাছাকাছি সে আসতে চায় না কারণ মানুষ তো প্রাণী হিসেবে অন্য প্রাণীর খুব একটি নির্ভরযোগ্য বন্ধু নয়। ইয়েতি হয়তোবা প্রকৃতিগতভাবেই তা জেনে গেছে।
রেনহোল্ড মেসনারের কাহিনী.......
দিনের আলো তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চারপাশের উচুঁ পাহারের মাথায় তখনও লেগে রয়েছে কমলা রঙের রোদ। চিরপাইন ও সেডার জঙ্গলের নিচেও ক্রমশই কমে আসছে আলো। আর ঘন্টাখানেটের মধ্যেই নিবিড় অন্ধকারে ছেয়ে যাবে এ বন পাহাড় ও নদী। এর পূর্বেই মেসনারকে পৌঁছতে হবে এমন একটি স্থানে যেখানে রাতটি কোনওভাবে কাটিয়ে দেয়া সম্ভবপর হবে। অরণ্যে রাত কাটানো বলতে অবশ্য স্রেফ পরিষ্কার একটি জায়গায় ‘ক্যারি ম্যাট’ বিছিয়ে ‘স্লিপিং ব্যাগ’ এর মধ্যে ঢুকে পড়া এবং ভোরের আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করা। যেহেতু সম্পূর্ণ একা, সঙ্গে একজন পোর্টারও নেই, তাই পিঠের রুকস্যাক হালকা রাখার জন্যে ডোম টেন্টটিও এবার মেসনার রেখে এসেছেন।
দুপুর পর্যন্ত আশা ছিল পথে কোথাও দেখা মিলবে তিব্বতি মেষপালকদের সঙ্গে আর তা’হলে তাদের ডেরায় রাত কাটানো যাবে আরামে। গত ক’দিন ধরে এমনিই হয়েছে। হয় কোনো তিব্বতি গ্রামে রাত কাটিয়েছেন, অথবা বনের মধ্যে মেষপালকদের তাঁবুতে ইয়াকের দুধ খেয়ে দিয়ে বানানো ঘন চা আর সাম্পা খেয়ে শুয়ে পড়েছেন ওদের সঙ্গেই। ইয়াক হচ্ছে তিব্বতি গরু বিশেষ। প্রায় বিশ হাজার ফুট উচুঁতে এরা বিচরণ করতে পারে। এদের পায়ে তীক্ষ্ন ক্ষুর রয়েছে। এদের গায়ে প্রচুর লোম থাকে। তিব্বতের মানুষ এদের ভারবাহী পশু হিসেবেও ব্যবহার করে। দুধ এবং মাংসের জন্যেও এদের বেশ কদর।
ইয়াকের বিষয়ে ভাবতে ভাবতে মেসনারের মনে হল আজ কিন্তু সারাদিনে কোনো গ্রাম চোখে পড়া দূরে থাক,কোনো মানুষের সঙ্গেও তার দেখা হয়নি। এমনকি কোনো ইয়াকের ডাকও কানে আসেনি। শেষপর্যন্ত বিকেল নাগাদ আশা ছেড়ে দিয়ে মনে মনে তৈরি হলেন আকাশের নিচে রাত কাটানোর জন্যে। তাঁর জীবনে এটি কোনো নতুন অভিজ্ঞতা ছিল না। বহুবারই তিনি একা রাত কাটিয়েছেন তিব্বতের দুর্গম উপত্যকায়। তবে আজকের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অন্যরকম! প্রথমত পূর্ব তিব্বতের এ অঞ্চলটি তাঁর একেবারেই অচেনা এলাকা। আর শুধু তিনি কেন কোনো অভিযাত্রীও এ পথে আসেনি। ফলে এদিককার অরণ্য সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যও তার জানা ছিল না। শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে মেসনারকে সামনে এগুতে হচ্ছে।
তবে এসব তাঁর কাছে কোনো ব্যাপার নয়। তারা কারণ, তাঁর নাম রেনহোল্ড মেসনার। ১৪টি এইট থাউজ্যান্ড শৃঙ্গজয়ের কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর অভিজ্ঞার ভাণ্ডারে। হিমালয়ের দুর্গমতম প্রান্তর ঘুরে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন, একা উঠেছেন এভারেস্ট চুড়োয়, কে-টু-তে, নাঙ্গা পর্বতে। পর্বতারোহীদের মধ্যে সারা পৃথিবী একবাক্যে তাঁকে সেরা বলে মানে। বলা চলে ‘অ্যালপাইন স্টাইল মাউন্টেরিয়ারিংকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন শিল্পের পর্যায়ে। নর্থ কল থেকে এভারেস্ট এর শীর্ষে উঠে নেমে এসেছেন মাত্র আড়াই দিনে, তাও আবার অক্সিজেন ছাড়াই। এ হেন পোড় খাওয়া পর্বতারোহী একা জঙ্গলে রাত কাটাতে ভয় পাবেন তা তো ভাবাই যায় না।
অবশ্য মেসনার নিজেও ভাবেননি। নামহীন একটি পাহাড়ী নদী পার হয়ে ভিজে পোশাকে উল্টোদিকের খাড়া পার বেয়ে উঠতে উঠতে যখন রাত কাটানোর জন্যে একটু পরিষ্কার স্থান খুঁজছেন মেসনার, তখনও তিনি ঘুণাক্ষরে টের পাননি যে, আর মাত্র ঘন্টাখানেকের মধ্যে ঘটতে চলেছে এমন একটি অভাবনীয় ঘটনা যা তাঁর পরবর্তী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে নাটকীয়ভাবে।
নদীর পাড়টি বেশ খাড়াভাবে প্রায় ৩০০ ফুট উঠে গিয়ে একটি ঢালু জায়গায় মিশেছে, তার ঠিক গা থেকেই শুরু হয়েছে রডোডেনড্রনের জঙ্গল। মেসনার চাইছিলেন জঙ্গলটি পার হয়ে কোনো একটি ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে রাত কাটাতে, তাই দ্রুত পা চালালেন। এদিকে বিকেল গড়িয়ে নামছে সন্ধ্যা সে সঙ্গে ঠাণ্ডাও বাড়ছে দ্রুত। জোরে হাঁটলে শরীর গরম থাকবে, ফলে যত জোরে পারা যায় হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। আর ঠিক তখনই ঘটলো ব্যাপারটি।
রডোডেরড্রন ঝোঁপের আড়াল থেকে হঠাৎই বেরিয়ে এল কালো রঙের বিশাল প্রাণীটি। মেসনারের সামনে, আন্দাজ ৩০ ফুট দুরত্বে। অন্ধকারে প্রথমটি ঠিক ঠাহর করতে পারেননি তিনি। প্রথম দেখায় মনে হল, হয়তো এটি একটি ইয়াক। তার মানে নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছে কোনোও মেষপালকের তাঁবু- ভেবে খুবই খুশি হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু ভাল করে ভাবতেই এক সেকেণ্ডের মধ্যে ভুলটি ভেঙ্গে গেল তাঁর। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাঁকে বলে দিল, ওটি ইয়াক নয়। কোনো মতেই নয়। কিন্তু তা’হলে ওটি কি? চোখ কচলে আরও ভালোভাবে তাকালেন তিনি। ছায়াচ্ছন্ন রডোডেনড্রন ঝোপে প্রাণীটি তখনও নিশ্চল দাঁড়িয়ে। এবং ভালোভাবে তাকিয়ে মেসনার দেখলেন, প্রাণীটি দাঁড়িয়ে আছে চার পায়ে নয়, দু’পায়ে।
কয়েকটি মুহূর্ত একেবারেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে। এবং ভালোভাবে তাকিয়ে মেসনার আবারো দেখলেন, প্রাণীটি দাঁড়িয়ে আছে চার পায়ে নয়, দু’পায়ে।
কয়েকটি মুহূর্ত একেবারেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে দু’জনেই। মুখোমুখি। পোড়-খাওয়া পর্বতারোহীর প্রতিটি স্নায়ু টানটান হয়ে উঠেছে আসন্ন বিপদের মোকাবিলার অথচ প্রাণীটির দিক থেকে আক্রমণের কোনো লক্ষণ নেই। এভাবেই কাটল আরও দু‘এক সেকেন্ড। না’কি আরও বেশি সময়? এমন অদ্ভূত এক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে সময়ের বোধ হারিয়ে গিয়েছিল মেসনারের। সংবিৎ ফিরল প্রাণীটি হঠাৎ নড়ে উঠায়। মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলের ভিতরে প্রাণীটি ঢুকে গেল। তারপরেই আবার বেরিয়ে এল, প্রায় একই জায়গা দিয়ে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সোজা এগিয়ে এল গজ দশেক, যেন অপরিচিত এ দু’পেয়ে প্রাণীটিকে ভয় দেখাবার জন্যেই। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল আবার। এবং তারপর যেভাবে নিঃশব্দে এসেছিল, ঠিক তেমনই নিঃশব্দে উঠে গেল ঢাল বেয়ে।
মেসনারের মাথা কাজ করছিল না। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তিনি লক্ষ করেছেন, প্রাণীটি হাঁটাচলা করেছে আগাগোড়া পেছনের দু’পায়ে মাটিতে লাগায়নি। আরও বিস্ময়কর প্রাণীটির গতি। প্রায় সাড়ে সাত ফুটের কাছাকাছি লম্বা ওরকম ভারী চেহারার একটি প্রাণী জঙ্গল থেকে বেরোল, ঢুকল, আবার বেরোল- অথচ একটি গাছের ডাল ভাঙল না, একটি পাথর গড়িয়ে পড়ল না- এটি কি করে সম্ভব? এবং প্রাণীটি হাঁটে অসম্ভব ক্ষিপ্রগতিতে, প্রতি পদক্ষেপে প্রায় ফুটতিনেক অতিক্রম করে, অথচ একবারও হোঁচট খায় না, পাহাড়ে চড়তে ওস্তাদ, দক্ষ মাউন্টেনিয়ারদেরও লজ্জায় ফেলে দিতে পারে তার গতি।
প্রাণীটি চলে যাওয়ার পর প্রায় মিনিটদশেক ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন মেসনার। দক্ষ পর্বতারোহী, বিপদে ধৈর্য্য রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তাঁর। বহুবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন, ‘ক্রেভার্স’ এ পড়ে একা বেরিয়ে এসেছেন সেই মৃত্যুগহ্বর হতে। ফলে মাথা গুলিয়ে যাবার কথা নয় তাঁর। কিন্তু কিছুতেই তিনি বুঝতে পারছিলেন না, যে প্রাণীটি তিনি দেখেছেন সেটি কি? ইয়াক নয়, তিনি নিশ্চিত। তবে কি ভালুক? হিমালয়ান ব্রাউন বিয়ার? অত বড় তো হবার কথা নয় ভালুকের! আর এ অবিশ্বাস্য গতি? আর দু’পায়ে হাঁটা? তবে কি, তবে কি......
একটি সম্ভাবনার কথা ইতিমধ্যেই দ্রুত পাক খেতে শুরু করেছে তাঁর মাথায়। এ কি সেই প্রাণী, যার রহস্যময় পদচিহ্ন দেখেছেন বহু পর্বতারোহী? এ কি সেই রহস্যময় প্রাণী, যাকে নিয়ে নানা গল্পকথা ছড়িয়ে আছে পশ্চিম কারাকোরাম থেকে পূর্বে চেংদু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে? ভাবনাটা মনে ঢোকার পর থেকেই একঝাঁক তথ্য মাথায় ভিড় করে এল। পূর্ব-তিব্বতের এই অঞ্চলে ইয়েতি দেখা গেছে বলে তো শোনা যায়নি কখনও! ইয়েতির পায়ের ছাপ বা লোকালয়ে ইয়েতির আক্রমণ বিষয়ে যত কাহিনী শোনা গেছে, তার প্রায সবই নেপালে-চোয়ু, এভারেস্ট মাকুলা অঞ্চলে শেরপাদের গ্রামে এসে ইয়েতি ইয়াক মেরেছে বলে শোনা গেছে, মাকালু পর্বতের কাছাকাছি বরুন উপত্যকায় শেরপারা জঙ্গলের মধ্যে ইয়েতি দেখেছেন বলে শোনা গেছে, মাকালু পর্বতের কাছাকাছি বরুন উপত্যকায় শেরপারা জঙ্গলের মধ্যে ইয়েতি দেখতে পাওয়ার কোনও রিপোর্ট নেই! তা হলে কি বানর গোত্রের কোনও প্রাণী? কিন্তু এই উচ্চতায় কোনও ‘প্রাইমেট’ থাকতে পারি কি? সব মিলিয়ে রীতিমত ধাঁধায় পড়ে গেলেন মেসনার।
হিমালয়ের বিরলমত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, এটা টের পাওয়ার পাশাপাশি, মেসনার টের পাচ্ছিলেন, ক্রমেই একটা অজানা আশঙ্কা ঘিরে ধরছে তাঁকে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাঁকে বলছিল, আজকের রাতটা খুব নিশ্চিন্তে কাটবে না। যষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি বুঝতে পারছিলেন, রাতে আবারও ফিরে আসতে পারে প্রাণীটা। সেক্ষেত্রে এই জঙ্গলে থাকা কতটা নিরাপদ? তিনি কি ফিরে যাবেন নদী পার হয়ে? কিন্তু প্রাণীটা যে তাঁকে অনুসরণ করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর ওর ক্ষিপ্রতার যে পরিচয় এক্ষুনি পেয়েছেন তিনি, তাতে দৌড়ে পালাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রাতের অন্ধকারেও দিব্যি দেখতে পায় প্রাণীটা, তাও বোঝা গেছে। সেক্ষেত্রে তিনি তো আরও অসহায়।
ঠিক তখনই আর একটি চিন্তা মাথায় খেলে গেল তাঁর। কী আফসোস! কেন যে একটা ছবি তুললেন না প্রাণীটার! এই আলো আঁধারিতে অবশ্য পরিস্কার ছবি আসত না। অবধারিতভাবে ‘আন্ডার এক্সপোজ’ ছবি হত। কিন্তু তা-ই বা কম কী? হাতে অন্তত একটা প্রমাণ থাকত তাঁর। যদি এটা সত্যিই ইয়েতি হয়, তা হলে ওই ফোটোগ্রাফটাই হয়ে উঠত অমূল্য। অবশ্য এ-কথাও ঠিক, ওই মুহুর্তে ছবি তোলার কথা মাথায় আসাই সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভেবে খুবই খারাপ লাগল তাঁর। কোনও প্রমাণ দেখাতে না পারলে লোকে কি তাঁর কথা বিশ্বাস করবে?
সমস্ত মনোযোগ ও সতর্কতা একত্র করে পা টিপে-টিপে মেসনার এগুলেন রডোডেনড্রনের ঝোপটির দিকে। আলো তখন প্রায় নেই। র্যাকস্যাক থেকে টর্চটি বের করলেন বটে, কিন্তু জ্বাললেন না। যদি জানোয়ারটি কাছাকাছি আলো জ্বাললেন না। আলো জ্বাললে যদি সে মেসনারের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মেসনার প্রায় নিঃশব্দে এসে পৌঁছলেন ঝোপটির সামনে। খুব কম আলোয় চোখ প্রায় মাটির কাছাকাছি নিয়ে দেখতে পেলেন স্যাঁতসেতে মাটিতে স্পষ্ট পায়ের দাগ। গোড়ালি এবং প্রতিটি আঙুলের ছাপ একেবারে স্পষ্ট। সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ঐ পায়ের ছাপের ফোটো তুললেন তিনি। ছাপের গভীরতা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, প্রাণীটি যথেষ্ট ভারী।
কিন্তু খুব বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে ভরসা পেলেন না তিনি। সোজা এগিয়ে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব জঙ্গল পার হয়ে যখন পাথুরে জমিতে পৌঁছলেন, তখন ঘড়িতে রাত আটটা বাজে। জঙ্গল সেখানে তেমন ঘন নয়, অনেক নিচে শোনা যাচ্ছে নদীর আওয়াজ। খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে রাত কাটানোর মতো জায়গার সন্ধান করতে শুরু করেছেন মেসনার, এমন সময় হঠাৎই শুনতে পেলেন তীক্ষ্ন শিসের মতো আওয়াজ। পাহাড়ি ছাগল অনেক সময় এভাবে ডাকে বটে, কিন্তু সে ডাক এত তীক্ষ্ন ও জোরালো নয়। থমকে গেলেন মেসনার।
পরপর দু’বার, খানিক পরে আবার এমনটি শোনা গেল। এবার আড় চোখে ডান দিকে তাকাতেই দেখলেন ফিরে এসেছে প্রাণীটি। অন্ধকারেও বিশাল কালো দেহের আউটলাইনটি স্পষ্ট দেখতে পেলেন মেসনার। প্রাণীটি এগিয়ে এল আরও কাছে, হাঁটুর ওপর সামনের দুপায়ের পাতায় ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালো। আর একবার সেই হুইসেলের মতো শব্দ মুহূর্তের জন্যে চকচকে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠল আবছা চাঁদের আলোয়। প্রাণীটির সারা দেহে বড় বড় লোম, সামনের পা দুটি পেছনের পায়ের চেয়ে অনেক বড়, শরীর মানুষের তুলনায় অনেক ভারী, কাঁধও যথেষ্ট চওড়া। খানিকক্ষণ পরে আবার শিসের মতো আওয়াজ করে ছুট লাগাল প্রাণীটি। এবার সোজা উল্টো দিকে। চাঁদের আলোয় মেসনার দেখতে পেলেন, চড়াই বেয়ে অবলীলাক্রমে উঠে যাচ্ছে প্রাণীটি। একবারও না থেমে যে গতিতে সে উঠছে তাতে স্পষ্ট ওর ফুসফুস মানুষের চেয়ে অনেক সুগঠিত, অনেক বেশি অক্সিজেন ধরার ক্ষমতা রাখে। আর ওর পায়ের পেশি কতখানি শক্তিশালী, তার প্রমাণ তো সন্ধ্যাবেলায় আরও একবার পেয়েছেন তিনি।
শিসের আওয়াজ আরও কয়েকবার পেলেন মেসনার। আওয়াজ থেকে টের পেলেন মেসনার, দূরে জঙ্গলের দিকে চলে যাচ্ছে প্রাণীটি। কিন্তু না, আর ঝুঁকি নেবার কোনো মানে হয় না।
সে রাতে আর প্রাণীটি আসে নি। আরও কয়েকদিন হেঁটে তিব্বতের রাজধানী লাসায় পৌঁছলেন মেসনার। লাসার হোটেলে তার বন্ধু সাবিনা সব শুনে অদ্ভূত হাসি হেসে বললো, ‘তোমার মাথা ঠিক আছে তো?’ দীর্ঘদিন একা পাহাড়ে ঘুরে মেসনারের মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে বলে মনে করলেন তিনি। এমনটি ভাবা অবশ্য অমূলকও নয় কারণ, উচ্চতাজনিত কারণে ও হাইপক্সিয়ায় বা অক্সিজেন স্বল্পতাজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত অনেক পর্বতারোহীরই মাথায় গোলমাল দেখা দেয়। সাময়িকভাবে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায় এমন উদাহরণও রয়েছে। তবে যে মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে উচুঁ ১৪টি শৃঙ্গ জয় করেছেন অক্সিজেন ছাড়াই, নিজের অভিযানের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ৩০টিরও বেশি বই, গোটা ইউরোপে করেছেন অসংখ্য ‘লেকচার টুর’, তাঁর মাথা গোলমাল করবে মাত্র ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায়- এটি ভাবা যায় না। কিন্তু সাবিনা বিশ্বাসই করতে চাননি মেসনারের কথায়। তার ধারণা ছিল এটি ঝানু পাহাড়ির কোনো ‘প্র্যাকটিক্যাল জোক’ বুঝি!
নিজে যা দেখেছেন, তা অন্য কাউকে বোঝাতে না পারলেও, নিজের অভিজ্ঞতার স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টার কোনো ক্রটি রাখলেন না মেসনার। ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে পূর্ব তিব্বতের নেকং নদীর উপত্যকায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে প্রাণীটির সঙ্গে আচমকা দেখা হয়েছিল তাঁর, সেটি ইয়েতিই, না’কি অন্য কিছু, তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু করে দেন তিনি। টানা ১৪ বছর ধরে তিব্বত, নেপাল, ভুটান, সিকিম, চীন ও পাকিস্তানের হিমালয় সংলগ্ন অংশে ঘোরাঘুরি করে তিনি যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তাই নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি বই। ‘ম্যাকমিলান’ থেকে প্রকাশিত ‘ মাই কোয়েস্ট ফর দ্য ইয়েতি, কনফ্রন্টিং দ্য হিমালয়াজ ডিপেন্ট মিস্ট্রি’ বইতে রয়েছে ১৪ বছর ধরে ইয়েতি বিষয়ে মেসনারের অনুসন্ধানের কাহিনী।
মেসনারের অনুসন্ধান পর্ব....
ইয়েতির খোঁজে ১৪ বছর ধরে কোথায় না গিয়েছেন মেসনার। ১৯৮৬ সালের গরমের সময়ে পূর্ব তিব্বতের খাম থেকে কানজে অঞ্চলের তারচেন গুম্ফা, সেখান থেকে লাসা। ঐ একই বছরে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এভারেস্টের পূর্বদিকে পেথাসে - চোমোলোনজো- মাকালু অঞ্চলের অরুণ এবং বরুণ উপত্যকার প্রত্যন্ত গ্রাম সেদুয়ায়, অক্টোবরে নেপালের সোলু খুম্বু উপত্যকায়- সর্বত্র তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন গল্পকথার ইয়েতিকে খুঁজে বের করার জন্যে। নেপালের মানুষের কাছে, বিশেষত শেরপাদের কাছে ইয়েতি এক রহস্যময় প্রাণী- বাস্তবের মাটি থেকে পুরাণের কাহিনী, সর্বত্রই তার রয়েছে অবাধ বিচরণ। দু’পায়ে হাঁটে এ বিশাল প্রাণীটি, গ্রাম থেকে ইয়াক, ছাগল, এমনকি ছোট ছেলেমেয়েদেরও তুলে নিয়ে যায়, মানুষ দেখলে তীক্ষ্ন শিসের মতো আওয়াজ করে, ছুঁড়ে মারে পাথর। অনেকের মতে প্রাণীটি না’কি নিশাচর, দিনের বেলা কেউ কখনও তাকে দেখেনি। শুধু বরফের ওপর দেখতে পাওয়া যায় তার পায়ের ছাপ, যা কি’না মানুষের পায়ের ছাপেরই মতো, কেবল আকারে বড়। শেরপাদের বিশ্বাস, ইয়েতি না’কি অশুভ, যে গ্রামের কাছাকাছি ইয়েতি দেখা গেছে, সে গ্রামে না’কি শিগগিরই নেমে আসবে কোন অজানা বিপদ।
মাকালু অঞ্চলে ইয়েতির দেখা না পেলেও তার পায়ের অনেক ছাপ দেখতে পান মেসনার, আর তার চেয়েও বেশি শুনেছেন ইয়েতিকে নিয়ে নানা লোম খাড়া করা বিশ্বাসযোগ্য-অবিশ্বাস্য কাহিনী। শেরপাদের মধ্যে প্রচলিত সেসব গল্পের সবই না’কি সত্যি ঘটনা। অবশ্য এধরনের সত্যি ঘটনা শুধু মাকালুতেই নয়, হিমালয়ের সর্বত্রই কমবেশি শুনেছেন মেসনার। ’৮৭ সালে হিন্দুকুশ ও পশ্চিম ভূটানের জঙ্গলেও স্থানীয় মানুষরা তাঁকে শুনিয়েছে ইয়েতির গল্প। ’৮৮ সালে তিব্বতের আমদো থেকে খাম পর্যন্ত দীর্ঘ পথ একা হেঁটে ঘুরেছেন মেসনার। গিয়েছেন পামির অঞ্চলে, আবার সিকিমের জঙ্গলেও। ১৪ বছরের এ দীর্ঘ অনুসন্ধান থেকে এ সিদ্ধান্তে এসেছেন মেসনার যে, ইয়েতি আসলে যতটা বাস্তবের, ঠিক ততটিই কল্পনার।
স্নো লাইনের কাছাকাছি ১২,০০০ ফুট থেকে ১৮,০০ ফুট উচ্চতায় এ ধরনের কোনো ‘প্রাইমেট’ থাকতে পারে, এ তত্ত্ব বিলকুল খারিজ করে দিয়েছেন তিনি। যেসব বিজ্ঞানী দাবি করেন যে ইয়েতি আসলে জাইগ্যান্টোপিথেকাসের স্বগোত্রের আদি মানুষ, নিয়েন্ডারথালের দূর সম্পর্কের আত্নীয়, তাঁদের যুক্তিকেও মেসনার উড়িয়ে দিয়েছেন এককথায়। তার মতে ইয়েতি কোনো ‘হোমিনিড’ নয়, এ ব্যাপারে তিনি একেবারে স্থিরনিশ্চিত।
কিন্তু তাহলে ইয়েতি আসলে কি? পুরোটিই কি কল্পনা? কোনো বাস্তব ভিত্তি না থাকলে কি এভাবে কল্পনায় কোনো জীবের অস্তিত্ব খাড়া করা সম্ভব? আর যদি তা কল্পনাই হবে, তাহলে ১৯৫৩ সালে মেলুং হিমবাহ অঞ্চলে এরিক শিপটন যে বিশাল পায়ের ছাপ দেখেছিলেন, তা কার ছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।
শেরপাদের মধ্যে ইয়েতি নিয়ে যত কাহিনী শোনা যায়, সেগুলোর কি তাহলে কোনোও মূল্যই নেই? সব গাঁজাখুরি গল্প।
‘মাই কোয়েস্ট ফর ইয়েতি’ বইয়ে এসব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন মেসনার। এদিক থেকে দেখতে গেলে ইয়েতি বিষয়ে আজ পর্যন্ত যত লেখালেখি হয়েছে, তার মধ্যে এ বইটিই সবচেয়ে প্রামাণ্য। কারণ বিগত ৫০ বছরের ইয়েতি সংক্রান্ত সব কাজের প্রায় প্রতিটিই এখানে পর্যালোচনা করেছেন মেসনার। শিপটন, হিলারি, আর্নস্ট শেফার যতজন ইয়েতি নিয়ে খোঁজখবর করেছেন, তাঁদের সবাইকেই এ দুমলাটের বইয়ে হাজির করেছেন মেসনার। নিজের অভিজ্ঞতাকে বিচার করতে চেয়েছেন অতীতের বিবরণের আলোয়। এভাবে মেসনারের নিজের অনুসন্ধানও পেয়ে গিয়েছে এক ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত।
‘মাই কোয়েস্ট ফর ইয়েতি সেদিক থেকে দেখতে গেলে আসলে গত ১৪ বছরের নয়,‘গত ৫০ বছরের গবেষণার ফসল’। নিজের গবেষণার পাশাপাশি অতীতের গবেষণালবদ্ধ ফলাফলগুলো উল্লেখ করে মেসনার আসলে কল্পনা ও বাস্তবের ইয়েতির সম্পূর্ণ চেহারাটিই ধরতে চেয়েছেন।
ইয়েতি আসলে, কি, এ প্রশ্নের উত্তরে মেসনার স্পষ্ট জানাচ্ছেন, এর সঙ্গে মানুষ বা বানরের কোনও সম্পর্ক নেই। ‘স্নোম্যান’ নামটাই আসলে যত নষ্টের গোড়া। মিডিয়ার দেয়া ঐ নামই বিভ্রান্ত করেছে সাধারণ মানুষকে। তুলনায় ইয়েতি নামটি বাস্তবের অনেক কাছাকাছি। তিব্বতি শব্দ ইয়েতির মূল অর্থ ভালুক-মানুষ। এছাড়া মেসনার মনে করেন, ইয়েতি কাহিনীর পেছনে রয়েছে হিমালয়ের এক অতি দু®প্রাপ্য প্রজাতির ভালুক। তিব্বতে এ প্রাণীটিকে ডাকা হয় ‘চেমো বা চেমাং’ বলে। কোন কোন অঞ্চলে ডাকা হয় ‘তচুতে’, ‘মিতেও’ বা ‘মিগিও’ নামে। ভুটানে এর স্থানীয় নাম ড্রেমো’, কারাকোরামের রিয়াফো, বালতোরো, হিসপার ও ‘ড্রেমং’। এটি অত্যন্ত বিরল প্রজাতির প্রাণী, ‘আরসাস’ গণের, কিন্তু ‘হিমালয়ান ব্রাউন বিয়ার’-এর সঙ্গে এর চালচলনের তফাৎ লক্ষণীয়। এই প্রাণীটি অত্যন্ত নির্জনতাপ্রিয়, মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে, একান্তভাবে নিশাচর এবং সর্বভুক। বাঁশের কোঁড়, বুনো কন্দ থেকে শুরু করে পাহাড়ি ছাগল- সবই খায়। মেসনারের মতে ‘আরসাস আর্কটাস’ প্রজাতির ভালুকেরই কোন ‘মিউট্যান্ট’ বিরল এই প্রাণীটি। এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য, দু’পায়ে চলাফেরা করতেই বেশি অভ্যস্ত এ ভালুকরা।
মেসনার তাঁর বইয়ে শুধু চেমো-র কথা উল্লেখ করেই থেমে যাননি। ‘ইয়েতি মিথ’ -এর পেছনে লুকিয়ে থাকা বাস্তবের বিরল এ প্রাণীটিকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি কিভাবে এটি পাহাড়ের ‘মিথলজি’-তে ভালুক থেকে ইয়েহিততে রূপান্তরিত হল, তারও হদিস দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এবং এভাবেই ‘মাই কোয়েস্ট ফর ইয়েতি’ হয়ে উঠেছে তিব্বত, নেপাল ও হিমালয় সংলগ্ন সব দেশের মানুষের জীবনেরও এক চলমান প্রতিচ্ছবি।
হিমালয়ের পাহাড়ি মানুষ তেমন ভালুকের শরীরে কল্পনার পোশাক পরিয়ে তাকে করে তুলেছেন ইয়েতি। কল্পনার এ ইয়েতি তিব্বতিদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ আর পশুর মধ্যমর্তী এক স্তর। বুদ্ধিতে ইয়েতি নাকি পশুদের চেয়ে ওপরে। সে নাকি এমনকি মানুষের গলার স্বরও নকল করতে পারে।
...........
যুগ যুগ ধরে কল্পনার ওপর আরও কল্পনার স্তর পড়তে-পড়তে হারিয়ে যায় মূল বিষয়টিই। কল্পনাই তখন হয়ে ওঠে বাস্তব। এভাবেই জন্ম নেয় গল্পের ইয়েতি, যা আজও অতি সম্প্রতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিবরণীতেও স্থান পেয়ে মিডিয়া উঠে এসেছে। সবশেষে বলা চলে প্রকৃতির সব কিছু জেনে যাওয়া উচিত নয়, চেষ্টা করাও উচিত না। থাকনা প্রকৃতির নিজস্ব কিছু রহস্যময়তা যা মানুষকে যুগ যুগ রাখবেন কল্পনাপ্রবণ করে।