ডারউইনের নাম আজ আমরা প্রায় সবাই জানলেও তাঁর বই ‘দ্যওরিজিন অব স্পিসিস’ এ আসলে কি ছিল সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা হয়তোবা আজও স্পষ্ট নয়। না, বানর বা বনমানুষের থেকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে এ কথা ডারউইন তাঁর ‘দ্যওরিজিন অব স্পিসিস’ এ একবারও বলেন নি। তিনি শুধু দেখিয়েছিলেন, বেঁচে থাকার স্বার্থে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে একটি প্রজাতি আস্তে আস্তে বদলে যেতে যেতে নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়।..............
যতদিন মানব সভ্যতা টিকে থাকবে ততদিন ডারউইনের নাম উচ্চারিত হবে এরিস্টটল, কোর্পানিকাস, নিউটন ও আইনস্টাইনের সাথে। আর সেই সাথে আমাদের মনের কোণে উঁকি দেবেন আর একজন মানুষ। বলাবাহুল্য তিনি হলেন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। কারণ তাঁর প্রাপ্য খ্যাতি ও সম্মান তিনি পান নি। পান নি নিছক দুর্ভাগ্যের কারণে। যেমন, রেডিও আবিষ্কারের খ্যাতি পেয়েছেন মার্কোনি, অথচ তা পাবার কথা ছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর। আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস যদি তার গবেষণার খসড়াটি সরাসরি লিনিয়ান সোসাইটিকে পাঠাতেন, তা’হলে হয়তো ডারউইনের জায়গায় তাঁর নামই লেখা হত ‘বিবর্তনবাদের জনক’ হিসেবে।
সূচনাপর্ব
ডারউইনই কি প্রথম বিবর্তনবাদের আবিষ্কার করেন? না’কি তার সমসাময়িক আর এক প্রকৃতিবিদ ওয়ালেসও এ তত্ত্ব আবিষ্কারের দাবিদার? এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে প্রাপ্ত কিছু তথ্যের ভিত্তিতে।
ডারউইনের ‘দ্য অরিজিন অব স্পেসিস’ বইটি তখন সবে মাত্র বেরিয়েছে। বইটির প্রকাশক ছিলেন ল-নের জন মুরি। উল্লেখ্য, যে প্রকাশিত হবার আগেই বইটি অগ্রিম বিক্রি হয়েছিল ১২৫০ কপি। এরপর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই গোটা ইউরোপ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মানুষ বলাবলি করতে থাকলো চার্লস ডারউইন নাকি বানরকে মানুষের পূর্বপুরুষের সম্মান দিয়েছেন। গোড়াপন্থী মানুষরা এ মতবাদের বিরোধিতা শুরু করে দিল। তারা ডারউইনের এ বইয়ের বিবর্তনতত্ত্বের নাম দিলেন, ‘ মিঃ ডারউইনস মাংকি থিওরি’। মানুষ যাতে এ তত্ত্ব বিশ্বাস না করে, তার জন্যে তারা সবরকম অপপ্রচার চালিয়ে যেতে লাগলেন। কারণ, ডারউইনের কথা যদি বিশ্বাস করা হয় তা’হলে ঈশ্বরের মহিমাকে অবিশ্বাস করতে হয়। বানর যে আমাদের পূর্বপুরুষ সেকথা শুনে অনেকে তো বলেই বসলেন,‘ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি একথা যেন সত্যি না হয়, আর যদি সত্যি হয় তা হলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সাধারণ মানুষ যেন একথা জানতে না পারে। ’দু’জন দুঃসাহসী মানুষ টমাস হাক্সলে ও আর্নস্ট হেকেল ডারউইনের এ দুঃসময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। এছাড়া আরও যাঁরা তাকে সমর্থন করলেন তারা হলেন, বিশ্বখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ স্যার চার্লস লায়েল এবং উদ্ভিদবিদ যোশেফ ডালটন হুকার। অন্যদিকে হাক্সলে কেতো ইংল্যান্ডের মানুষ ডারউইনের পোষা ‘বুলডগ’ বলেই জানতেন।
ডারউইনের মতবাদের বিরুদ্ধে হইচই
১৮৬০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। সেদিন অক্সফোর্ড ব্রিটিশ এসোসিয়েশন অব অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স- এ ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বের ওপর কয়েকজনের গবেষণাপত্র পড়ার কথা। অক্সফোর্ডের বিশপ স্যামুয়েল উইলবার ফোর্স ঠিক করলেন, এ অনুষ্ঠানেই তিনি ডারউইনের মতবাদকে হাস্যকর বলে প্রমাণ করবেন। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন ‘জেনেসিস’ এর সৃষ্টিতত্ত্ব। বিশপকে আসলে তলেতলে ইন্ধন জোগাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়েন, ১৮৪২ সালে যিনি প্রথম ‘ডাইনোসর’ শব্দটি উদ্ভাবন করেছিলেন।
সেদিন তিলধারণের জায়গা ছিল না অক্সফোর্ড লাইব্রেরিতে। হাক্সলে চুপচাপ বসে ছিলেন প্রথমসারিতে। বসার স্থান না পাওয়াতে বহুলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। গবেষণাপত্রগুলো পড়া শেষ হলে বিশপ প্রায় আধঘন্টা ধরে ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। তারপর ভিক্টোরিয়া আমলের মাতৃত্বের জয়গান করে নাটকীয়ভাবে হাস্কলের দিকে আঙুল তুলে একটি চূড়ান্ত অশোভনীয় প্রশ্ন করে বসলেন! তিনি বললেন, ‘আমি কি হাক্সলে সাহেবের কাছে প্রশ্ন করতে পারি, তিনি তাঁর ঠাকুরমা অথবা ঠাকুরদা কোন দিক থেকে নিজেকে বানরের বংশধর বলে মনে করেন?’
হাক্সলে মন দিয়ে বিশপের কথা শুনছিলেন। তিনি ভাবতে পারেননি বিশপ তাঁকে এ ভাষায় আক্রমণ করে বসবেন। শান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন,‘মহামান্য বিশপ, আপনার প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই দেব। একটি বনমানুষ আপনার কাছে অতীব তুচ্ছ প্রাণী। তার না আছে তেমন বুদ্ধি, না পারে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে। আমাদের দেখে হয় তারা দাঁত বের করে হাসে না হয় চিঁচিঁ করে আওয়াজ করে। তা হলেও কিন্তু আমি পূর্বপুরুষ হিসেবে সেই মানুষের চেয়ে বনমানুষকেই বেশি পছন্দ করব, যে মানুষ তার শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে কাজে লাগিয়ে কুসংস্কার ও মিথ্যার বেসাতি করে’ তাকে নয়। হাক্সলের এ উত্তর কেউই আশা করেননি, বিশপ তো নয়ই। ফলে হাক্সলের উত্তর ভিক্টোরীয় আমলের চিন্তভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিল। ফলে বিশপ মুখে কুলুপ আঁটলেন ও ডারউইনের তত্ত্বকে আপতত আক্রমণ করার পরিবর্তে জানাবার সম্মানজনক পথ খুঁজতে শুরু করলেন। আর এর কয়েক বছরের মধ্যেই ডারউইনকে দেয়া হল ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ সম্মান রয়াল সোসাইটির ‘কপলে’ পদক।
কি ছিল ডারউইনের বইতে?
ডারউইনের নাম আজ আমরা প্রায় সবাই জানলেও বইটিতে আসলে কি ছিল সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা হয়তোবা আজও স্পষ্ট নয়। না, বানর বা বনমানুষের থেকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে এ কথা ডারউইন তাঁর ‘ওরিজিন অব স্পিসিস ’ এ একবারও বলেন নি। তিনি শুধু দেখিয়েছিলেন, বেঁচে থাকার স্বার্থে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে একটি প্রজাতি আস্তে আস্তে বদলে যেতে যেতে নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়। বহু উদাহরণ দিয়ে, ঘটনার পর ঘটনা ব্যাখ্যা করে তিনি তাঁর বইয়ের একেবারে শেষদিকে শুধু বলেছিলেন, সেই তত্ত্ব মানুষের উদ্ভব ও তার ইতিহাসের ওপর যা আলোকপাত করবে--" Light will be thrown on the origin of man and his history." এ একটি মাত্র কথাই গোটা বইয়ের বারুদে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দিল। বিরুদ্ধবাদীরা রটিয়ে দিল ডারউইন বলেছেন বানর হচ্ছে আমাদের পূর্বপুরুষ। এসময় ডারউইনকে নিয়ে বিভিন্ন কাগজে কার্টুন আঁকা শুরু হয়ে গেল। ভয়ানক বিদ্রুপের কার্টুন।
অবশ্য এ রটনা এবং ডারউইনের ধারণার মধ্যে খুব একটি পার্থক্য কিন্তু ছিল না। বনমানুষ ও আমাদের পূর্বপুরুষ যে এক সেকথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেও, তা যে সেসময়কার ধর্মীয় চিন্তধারায় চরম আঘাত হানবে তা তিনি জানতেন। তাই হয়তোবা কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর কথা মাথায় রেখে বনমানুষের প্রসঙ্গটি তিনি তার বইতে খুব সূক্ষèভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি কেবলমাত্র শেষ অক্ষরটি ছাড়া তিনি তাঁর বইতে ইভলিউশনের কথাও ব্যবহার করেন নি। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় নি।
ডারউইনের না বলা ভাবনা
১৮৭১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান’ বইটিতে ডারউইন পরিষ্কার বলেছেন, আফ্রিকাতেই বনমানুষের পূর্বপুরুষ থেকে একটি শাখায় বিভিন্ন বনমানুষ ও অন্য শাখায় মানুষের উদ্ভব হয়েছে।
সত্যিকার অর্থে এসব বিতর্ক এড়াতেই বোধ করি চার্লস ডারউইন তাঁর ‘ দ্য ওরিজিন অব স্পিসিস’ এর তত্ত্ব প্রকাশে তেমন আগ্রহ দেখান নি। নিজ বইয়ের উপকরণ সংগ্রহ করার জন্যে ডারউইন এইচ. এম এস বিগল জাহাজে ৪০ হাজার মাইল সমুদ্রযাত্রা করেন। পাড়ি জমান দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে। দেশে ফিরে আসার ২২ বছর পরে মালয় দ্বীপপুঞ্জের ছাপমারা একটি খাম হঠাৎই তাঁর বাসায় না পৌঁছালে ডারউইনের এ বই কোনোদিনও লেখা হত কিনা সন্দেহ। আসলে অন্য কেউ তার মতো করে ভাবছে এটি জানার পরেই তিনি তড়িঘড়ি করে বইটি প্রকাশে এগিয়ে আসেন। আর ঐতিহাসিক নথিপত্র সে কথাই বলে।
চার্লস ডারউইন এর প্রথম জীবন
বাপ-ঠাকুরদার মতো তাকেও ১৬ বছর বয়সে ডাক্তারী পড়ার জন্যে এডিনবরায় পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে মানুষের শরীর কাটাছেঁড়া করতে ভালো না লাগায় দু’বছরের মধ্যেই তিনি ডাক্তারী পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। তারপর ১৮২৭ সালে তাকে পাঠানো হয় কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। সেখানকার উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক জে. এস হেনস্থার সাথে তার ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে। কেমব্রিজের পাঠ শেষ করে বাড়ি আসার পর তখনকার দিনের আর পাঁচটি সচ্ছল ঘরের ছেলের মতো ধর্মযাজকের বৃত্তি গ্রহণ করার জন্যে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে হেনন্থা’র একটি চিঠি তাঁর জীবনের গতিপথ পাল্টে দিল। ১৮৩১ সালের ২৯ আগস্টের সে চিঠিতে হেনন্থা তাঁকে ব্রিটিশ জরিপ জাহাজ এইচ এম এস বিগল এ করে উত্তর আমেরিকা যাবার প্রস্তাব দেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিটজেরয়কে সঙ্গ দেয়াই হবে তাঁর প্রধান কাজ। তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে ঐ সমুদ্র যাত্রায় দু’বছর বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। ডারউইন কাকাকে দিয়ে বহু কষ্টে তাঁর বাবাকে রাজি করিয়ে সে বছরের ২৭ ডিসেম্বর পোর্ট মাউথ থেকে শুরু করলেন সেই সমুদ্র পরিক্রমা। তবে কয়েকমাস পর বিগল এর সরকারি ডাক্তার ও প্রকৃতিবিদ রবার্ট ম্যাককরমিক রিও-ডি -জেনেইরোতে জাহাজ ছেড়ে চলে যান। তখন ক্যাপ্টেন ডারউইনকে সরকারিভাবে প্রকৃতিবিদ হিসেবে নিযুক্ত করেন। পাঁচ বছর পরে ১৮৩৬ সালের অক্টোবর মাসে একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রায় ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত ডারউইন দেশে ফিরে আসেন। সাথে আনেন বহু পাথর ও প্রাণীকূলের অসংখ্য নমুনা।
ম্যালথাসের তত্ত্ব ও ডারউইন
ম্যালথাস ১৭৯৮ সালে লিখেছিলেন, ‘অ্যাসে অব পপুলেশন’। এ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন অপর্যাপ্ত খাদ্যের জন্যে কিভাবে দুর্ভিক্ষ, রোগ ও মহামারী জনসংখ্যাকে সীমাবদ্ধ রাখে। ১৮৩৮ সালের এক হেমন্তে ডারউইন খুব হালকাভাবেই পড়ছিলেন ম্যালথাসের সে প্রবন্ধ। তিনি অবাক হয়ে গেলেন যে, ম্যালথাসের ব্যাখ্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর। তিনি বিশ্লেষণ করলেন জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্যে প্রাণীদের যেসব বৈচিত্র্য সাহায্য করে, সেগুলো বংশপরম্পরায় সংরক্ষিত হয়। যেগুলো সাহায্য করে না, সেসব বৈচিত্র্য আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়। নতুন নতুন বৈচিত্র্যের সমাবেশে এক প্রজাতি রূপান্তরিত হয় অন্য প্রজাতিতে । একেই তিনি বলেছেন, ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’।
নতুন নতুন প্রজাতি উদ্ভবের কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে ডারউইন ১৮৪২ সালে ৩৫ পাতার একটি নোট লিখলেন পেন্সিল দিয়ে। এরপর ১৮ মাস ধরে লিখলেন, ‘ জিওলজি অব দ্য ভলক্যানিক আইল্যান্ড’ শীর্ষক নিবন্ধ। তারপর আবার ২৩০ পাতা জুড়ে কালি দিয়ে লিখলেন বিবর্তনতত্ত্ব। এ লেখা শেষ হয় ১৮৪৪ সালের জুলাই মাসের একেবারে প্রথমে। ৫ জুলাই ডারউইন তার স্ত্রীকে জানান যে, তাঁর জমানো অর্থ থেকে যেন ৫০০ পাউন্ড আলাদাভাবে তুলে রাখা হয় বিবর্তনতত্ত্ব প্রকাশের জন্যে। বইটি সম্পাদনার জন্যে তিনি লায়েল বা হুকারে নাম প্রস্তাব করেন। হঠাৎ মৃত্যুর কথা ভেবেই তিনি একথা লিখেছিলেন। এটিই তাঁর শেষ ইচ্ছা এবং সে ইচ্ছাকে যেন উইল এর মতো আইনগত মর্যাদা দেয়া হয়।
ডারউইনের এ চিঠি থেকে দুটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রথমত তিনি জীবিত অবস্থায় তত্ত্বটি প্রকাশ করে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাননি। দ্বিতীয়ত তিনি-ই যে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের প্রবক্তা সেটিই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে এরকম একটি চিঠির মতো লিখিত নথি রেখে দিয়ে। তাঁর মনে হয়তো সন্দেহ উঁকি দিয়েছিল যে, দ্বিতীয় কোনোও ব্যক্তি যদি একই সিদ্ধান্তে আসেন তা’হলে এব্যাপারে তাঁর অগ্রাধিকার যেন নিশ্চিত হয়।
স্ত্রীর কাছে এধরনের চিঠি লেখার পর সুদীর্ঘ ১৪ বছর কেটে গেল। ১৮৫৪ সালের ১৮ জুন তাঁর ‘ডাউন হাউস এর বাড়িতে ডাকে মালয় দ্বীপপুঞ্জের ছাপমারা একটি খাম এল। খামের ভেতরের কাগজপত্র পড়ে তিনি চমকে গেলেন। ভেবে কুল পেলেন না এখন তাঁর কি করা উচিত। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে সযতেœ, অতিসাবধানে, চুপচাপ যে তত্ত্বকে তিনি সুদৃঢ় করার জন্যে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পর্যায়তক্রমে সাজিয়েছেন, ডাকে আসা একজনের গবেষণাপত্র সে একই কথা বলছে। পত্রলেখকটি অবশ্য তার গবেষণাপত্রটি আবার চার্লস লায়েলের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। চিঠির শেষের নামটি ডারউইন বারবার পড়েছিলেন হয়তোবা। এ নামটি ছিল আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের।
ডারউইন চিঠি লিখলেন লায়েলকে. . .
ডারউইন সেদিনই চিঠি লিখলেন, আমি এর চেয়ে অবাক হবার মতো কোনো কাকতালীয় বিষয় আর দেখিনি। ওয়ালেস যদি আমার ১৮৪৪ সালের পা-ুলিপিটি পেতেন তা’হলে এর চাইতে ভালো কিছু সংক্ষিপ্তসার তৈরি করতে পারতেন না।’ লায়েলের কাছে তিনি উপদেশ চেয়ে লিখলেন, ‘ওয়ালেস যখন আমাকেই প্রথম লেখাটি পাঠিয়েছেন তখন আমার গবেষণাপত্রটিও একসাথে প্রকাশ করা কি শোভনীয় হবে?’ এর পরের লাইনেই লিখলেন, ‘ওয়ালেস বা অন্য কেউ এর জন্যে আমাকে অভদ্র বলে মনে করার চেয়ে নিজের পুরো পান্ডুলিপিটি পুড়িয়ে দেয়াই আমার কাছে শ্রেয়।’
বন্ধুর মুখ রক্ষার উদ্যোগ
ডারউইনের এ চিঠি পেয়ে লায়েল ও হুকার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাঁদের বন্ধুর মুখরক্ষার একটি ব্যবস্থা করলেন। ঠিক হল ১ জুলাই এর লিনিয়ন সোসাইটির সভায় দু’জনেরই গবেষণাপত্রের সংক্ষিপ্তসার পড়া হবে। সেসাথে ডারউইনের ১৮৪৪ সালে লেখা পান্ডুলিপিটি ও তাঁর স্ত্রীকে লেখা চিঠি দেখিয়ে প্রমাণ দেয়া হবে যে, ওয়ালেসের অনেক আগেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বটি লিখেছেন চার্লস ডারউইন। কিন্তু মজার কথা, দু’জনেই তাঁদের পান্ডুলিপিটি এতো সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন যে, সেদিন লিনিয়ান সোসাইটির সভায় উপস্থিত শ্রোতাদের কেউই ঘুণাক্ষরে টের পাননি যে, তাঁরাই একটি কালজয়ী তত্ত্বের প্রথম শ্রোতা। এমনকি, সে বছরের বাৎসরিক রিপোর্টে সোসাইটির সভাপতি টমাস বেল লিখলেন, গত বার মাসে কোনো বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয় নি। এরপর টানা একবছর ধরে নিজের পান্ডুলিপিটি বাড়িয়ে ডারউইন তাঁর সে তত্ত্ব প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর, প্রকাশিত হল সেই বহু প্রতীক্ষিত বই ‘দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’। আলফ্রেড ওয়ালেস তখন হয়তো বোর্নিওর গভীর অরণ্যে আদিবাসীদের সাথে কীটপতঙ্গ সংগ্রহে ব্যস্ত। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না। ডারউইনকে পাঠানো তাঁর সংক্ষিপ্ত গবেষণাাপত্রটির চাপেই উনিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়ে গেছে।
কে এই ওয়ালেস? কি করেইবা তিনি এ কাজটি করলেন
আলফ্রেড ওয়ালেস ছিলেন চার্লস ডিকেন্স এর পরিবারের ছেলে। তার জন্ম হয় ১৮১৩ সালে ইংল্যান্ডে। বাবার অবস্থা স্বচ্ছল না থাকার জন্যে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে রেল কোম্পানির জমি জরিপের চাকরি নিতে হয়। আর তখনই তিনি প্রকৃতির সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান। কীট-পতঙ্গ সংগ্রহের নেশা যেন তাকে পেয়ে বসলো। চাকুরি সূত্রে সাউথ ওয়েলস এর নিথ উপত্যকায় পাহাড়ে অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি ঠিক করে ফেলেন, জরিপের কাজ ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি প্রকৃতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। জীবিকার জন্যে দেশবিদেশ ঘুরে সংগৃহীত কীট-পতঙ্গ ও অন্যান্য বন্যজীব বিক্রি করবেন ইংল্যান্ডের জাদুঘরগুলোতে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছে। তিনি এ কাজে সাথী হিসেবে পেয়ে গেলেন তাঁর চেনা হেনরি বেটসকে। পরবর্তীকালে এ বেটসই কীট-পতঙ্গ এর নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত ‘ বেটেসিয়ান মিমিক্রি’ তত্ত্ব।
১৮৪৮ সালে তারা দু’জনে পারি জমালেন দক্ষিণ আমেরিকায়। দু বন্ধুর পকেটে তখন সর্বসাকুল্যে মাত্র ১০০ পাউন্ড। জাহাজে ভাসতে ভাসতে একদিন তাঁরা পৌঁছে গেলেন ব্রাজিলের মানাওস শহরে। এখানেই আমাজন এসে মিলেছে রিও নিগ্রো নদীর সাথে। কিছুদিন এখানে থেকে বেটস ফিরে যান নিজ দেশে। রিও নিগ্রো নদীতে ডিঙি নৌকা নিয়ে ওয়ালেস ঢুকে পড়েন আমাজনের গভীর অরণ্যে। সাথে কয়েকজন আদিবাসী। আমাজনের বৃষ্টিধোয়া (Rain Forest) অরণ্যের দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে যান প্রকৃতির ঐশ্বর্যে। কল্পনা করেন আকাশ থেকে এ অরণ্য দেখতে কেমন লাগবে। তাঁর ডায়রিতে লেখেন, ‘সম্ভবত পৃথিবীতে এমন কোনোও দেশ নেই যার মাটিতে আমাজন উপত্যকার মতো এত গাছপালা আছে। কয়েকটি ছোট জায়গা ছাড়া এর সমগ্র এলাকা ঢাকা আছে এক আদিম সুউচ্চ ঘন অরণ্যে। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বি¯তৃত এবং অবিভাজ্য অরণ্য। যদি বেলুনে চেপে ধীরে ধীরে এ অরণ্যের ফুলের মতো ঢেউ খেলানো মাথার ওপর দিয়ে বেড়ানো যায় তা’হলেই বোঝা যাবে এর মহিমা। সম্ভবত আগামী দিনের পর্যটকদের জন্যে এরকম সুযোগ অপেক্ষা করছে।’
ওয়ালেস রিও নিগ্রোর জঙ্গলে ছিলেন ৪০ দিন। তিনি সেখানকার স্থানীয় আদিবাসিদের সাথে তাঁর গড়ে তুলেছিলেন ঘনিষ্ট সম্পর্ক। অন্যান্য কীট-পতঙ্গ এর সাথে তিনি এখান থেকে ৪০ রকমের নতুন প্রজাতির প্রজাপতি সংগ্রহ করেছিলেন। সেসময়ে ইংল্যান্ডের মানুষ যখন এখানকার আদিবাসীদের বর্বর আখ্যা দিতে অভ্যস্ত ছিলেন, ওয়ালেস তখন তাঁদের সাথে ঘনিষ্টভাবে মিশে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের বর্বর বলা কতবড় অন্যায়! তাঁদের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে গড়ে ওঠা উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে তিনি তাঁদের শ্রদ্ধা না করে পারেন নি। এক কবিতায় তিনি লিখেছেন যে, এখানকার আদিবাসীদের দেখে তিনি ইংরেজ ছেলেমেয়েদের জন্যে করুণা অনুভব করেন। একটি কবিতার শেষে দু’ছত্রে তিনি লিখেছেন-
‘I’d be an Indian here, and live content
To fish and hunt and paddle my canoe,
And see my children grow, like young wild fawns,
In health of body and in peace of mind,
Rich without wealth and happy without gold’.
‘আমাজন নদীর অববাহিকায় বিভিন্ন জায়গায় চার বছর কাটিয়ে তিনি প্রচুর কীট-পতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণী সংগ্রহ করেন। তখনই তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে জীবজগতের এতো বৈচিত্র কি করে সৃষ্টি হল। তবে এর কোনো সদুত্তর তিনি খুঁজে পান নি। তারপর ১৮৫২ সালের জুলাই মাসে তাঁর সব সংগ্রহ নিয়ে দেশে ফিরে আসার জন্যে একটি মালবাহী জাহাজে চাপেন। এ জাহাজটি ছিল দাহ্য পদার্থ রেজিন বা রজনে ভরা। সপ্তাহ তিনেক কাটতে না কাটতে তাতে আগুন লেগে গেল। জাহাজের সাথে থাকা নৌকাতে চেপে তিনি কোনো মতে রক্ষা পেলেন। পুড়ে ছাই হলো তাঁর অশেষ কষ্টের সংগ্রহ অমূল্য সব নমুনা। শুধু পুড়লো না তাঁর অভিজ্ঞাটুকু।
কিন্তু তিনি দমলেন না। আবার তিনি পাড়ি জমালেন ১৮৫৪ সালে। এবার মালয় দ্বীপুঞ্জে দীর্ঘ আট বছর ধরে ঘুরে বেড়ালেন সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও ও নিউ গিনির দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। এসব জায়গার বন্য জীবন পর্র্যবেক্ষণ করে তিনি বুঝতে পারলেন, কোনো প্রজাতিই অপরিবর্তনীয় নয়। তবে কি করে তারা পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হচ্ছে তখনও তিনি তা বুঝতে পারেন নি। ১৯৫৮ সালে নিউ গিনি ও বোর্নিওর মাঝে মালাক্কার টারনেট আগ্নেয়দ্বীপে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এখানেই একদিন জ্বরের মধ্যে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করার সময় তার মনে হল ম্যালথাসের সে বিখ্যাত বইটির কথা। অতঃপর ডারউইনের মতো তিনিও একই সিদ্ধান্তে আসলেন যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই নতুন নতুন জীবের উদ্ভব ও বিবর্তন হয়। সেরাতেই ওয়ালেস অসুস্থ শরীরে লেখা শুরু করলেন তার গবেষণাপত্রের খসড়া। পরের দু’দিন চললো গবেষণাপত্রে চূড়ান্ত রূপ দেয়া। তারপর গবেষণাপত্রের সাথে একটি চিঠিসহ তা পাঠিয়ে দিলেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ডারউইনের কাছে। সে খাম পৌঁছাতে সময় লাগলো চার মাস। আর এর পরের কাহিনী তো আমাদের সবারই জানা।
ডারউইনের ‘দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটি আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে যে, মানুষ অন্য পাঁচটি জীবের মতো প্রকৃতিরই অংশ। তবে পরবর্তীকালের গবেষণায় ডারউইনের তত্ত্বের কতিপয় ভুলক্রুটি স্বাভাবিকভাবেই ধরা পড়েছে। ফলে বিকশিত হয়েছে ‘নয়া ডারউইনবাদ। তবু আজও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যতদিন মানব সভ্যতা টিকে থাকবে ততদিন ডারউইনের নাম উচ্চারিত হবে এরিস্টটল, কোর্পানিকাস, নিউটন ও আইনস্টাইনের সাথে। আর সেই সাথে আমাদের মনের কোণে উঁকি দেবেন আর একজন মানুষ। বলাবাহুল্য তিনি হলেন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। কারণ তাঁর প্রাপ্য খ্যাতি ও সম্মান তিনি পান নি। পান নি নিছক দুর্ভাগ্যের কারণে। যেমন, রেডিও আবিষ্কারের খ্যাতি পেয়েছেন মার্কোনি, অথচ তা পাবার কথা ছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর। আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস যদি তার গবেষণার খসড়াটি সরাসরি লিনিয়ান সোসাইটিকে পাঠাতেন, তা’হলে হয়তো ডারউইনের জায়গায় তাঁর নামই লেখা হত ‘বিবর্তনবাদের জনক’ হিসেবে।