সন্ধ্যা নামছে তখন। তপতী ভার্সিটি থেকে বাড়িতে ফিরল। ওর হাসিখুশি সৃন্দর মুখখানি আজ বড্ডো করুণ। এমনিতে তপতী চঞ্চল, তবু মাঝে মাঝে দেখা যায় ও নিশ্চুপ, তখন ওর আহত চোখ দু’টো অনুসন্ধিৎসায় কি যেন খুঁজে ফেরে।
ড্রইংরুমে সোহেল ভাইয়া বসেছিল। মা মারা যাবার পর, বাবা বিদেশ চলে যাওয়ায় তপতী এখন বড় চাচার বাসাতেই থাকে। সোহেল বড় চাচার একমাত্র ছেলে। তপতীর চেয়ে বছর চারেকের বড়। তপতীকে ঢুকতে দেখে সোহেল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে মুখ তুলে বলে, ‘কি রে তপু কেমন আছিস? মুখটা এমন শুকনো কেন?’ অনেক কষ্টে তপতী হাসবার চেষ্টা করে বলে, ‘ ও কিছু না তুমি বস, আমি বড্ডো ক্লান্ত আজ, একটু বিশ্রাম নেব ভাবছি।’
মাঝে মাঝে তপতী নিজের সব ব্যথা, কান্না লুকিয়ে যখন হাসি ফোটাতে চায়, তখন মনে হয় ওটা বুঝি হাসি নয় অব্যক্ত কান্না। মনে হয় বনের চঞ্চল হরিণীকে নেকড়ে তাড়া করলে সে যদি হাসে তবে তার হাসিটা যেমন কান্না ভেজা হয় তেমনি তপতীর হাসিও আজ কান্না ভেজা।
শ্লথ পায়ে নিজের ঘরে এলো তপতী। বইখাতা রেখে বিবশ অনুভূতিশূন্য দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। তারপর আস্তে আস্তে চোখের পাতা বন্ধ করলো। তপতীর সামনে শহীদ মিনারটা ভাসতে থাকে। সে দেখতে পায়, নগ্ন পায়ে, কালো ব্যাজ পড়া শতশত ছেলের মাঝে নাহিদকে।
’৭১ এর ৮ই ফাল্গুন বিকালে নাহিদ চুপটি করে তপতীর কাছে বসেছিল। মা হারা ভাইটিকে তপতী ওর প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। মায়ের পরে তপতীকেই নাহিদ নিজের সব কিছুতে আপন করে পেয়েছে।
সেদিন নাহিদ বলেছিল আপুমনি আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কিছু একটা অঘটন দেশে এবার ঘটতে চলেছে। আচ্ছা, আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়. . . ।’ ‘তুই থামবি নাহিদ।’ তপতী প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল।
তারপর. . . . ’৭১ এর এপ্রিল মাস। তপতী জানালার ধারে দাঁড়িয়েছিল। নাহিদ কখন এসে ঘরে ঢুকেছে লক্ষ্য করেনি সে। একটু ভেবে নিয়ে নাহিদ বলেছিল, আপামনি আমি যাচ্ছি।’
-সে কি রে কোথায় যাবি?
-আপতত শহরের বাইরে, তারপর ট্রেনিং ক্যাম্পে।
- কিন্তু চলে গেলে আমি এভাবে একলা… ।
আর বলতে পারে না তপতী দু‘চোখ জলে ভরে আসে। কিছুক্ষণের জন্য নাহিদ বিমূঢ় হয়ে যায়।সে ভাবতে চেষ্টা করে তার মা হারা আপামনি একা একা কিভাবে চাচা আর সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে থাকবে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, লক্ষ্মিটি, আপামনি, তুমি কেঁদনা, আমি মাস দু‘য়েক পরে এসে তোমাকে দেখে যাব। আর এখানে থাকা্ও আমার জন্য নিরাপদ নয়, যে কেউ পাকিস্তান আর্মিকে ইনফরম করতে পারে। তপতী আর কিছু বলে না, সস্নেহে নাহিদের কপালে, মুখে হাত বুলিয়ে দেয়, তারপর চোখের জল মুছে নাহিদের কপালে স্নেহের চুমু এঁকে দেয়।
’৭১ এর জুলাই মাসের এক সন্ধ্যায় নাহিদ আবার এসেছিল। শ্রাবণের আকাশ তখন কাঁদছে। রান্না ঘরের পিছনের দরজায় আস্তে আস্তে টোকা পড়ছিল। তপতী প্রথমটায় ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তারপর সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কে ওখানে”? মৃদু অথচ স্পষ্ট গলায় উত্তর এসেছিল, ‘আমি নাহিদ, আপামনি, দরজা খোল।’। আনন্দে তপতী চিৎকার করে উঠেছিল তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিয়েছিল। ঘরে ঢুকেই নাহিদ মুখে আঙুল দিয়ে তপতীকে চুপ করতে বলে। তারপর তপতীকে আস্তে আস্তে বলে, ‘সাবধান আপামনি , কেউ যেন জানতে না পারে আমি এসেছি’। তপতী মৃদু হেসে বলে সে ভয় নেই, বাসায় কেউ থাকলে তো!
- আহ্! বাঁচালে, কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। শুধু তোমাকে দেখতে এসেছিলাম। ঢাকায় আমাদের একটি গ্রুপ অপারেশনে এসেছে। মাত্র এক ঘন্টার ছুটি নিয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তপতী ভাবতে যাচ্ছিল অনেক কিছু, কিন্তু তাকে ভাববার কোন অবসর না দিয়ে নাহিদ বলে খুব ক্ষিধে পেয়েছে আপামনি, কিছু খেতে দাও। বাস্তবে ফিরে আসে তপতী ভাবনার রাজ্য থেকে।
- বস দিচ্ছি। রান্না ঘরেই মাদুর বিছিয়ে নাহিদকে খেতে দেয় সে। ভাত হয়েই গিয়েছিল। গরম গরম ভাত আর মুরগির মাংস পাতে দেয় তপতী। পরম তৃপ্তির সঙ্গে নাহিদ খায় আর তপতী ভাবনার সাগরে হারিয়ে যায়।
- কি ভাবছ এত বলত? একটু ঝোল আর মাংস দেবে তো, নাহিদ বলে। তপতী চমকে উঠে, তারপর বলে, ‘এই দেখ কি যে সব যাচ্ছেতাই ভাবছি।’
- কিছু ভেব না আপামনি, আমি আবার আসবো। কিন্তু আজ আর সময় নেই, বলেই নাহিদ দ্রুত হাত ধুয়ে নেয়। কিছুক্ষণ দু‘ভাইবোন দু’জনার চোখের পানে তাকিয়ে থাকে। তপতীর একটিা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে নাহিদ বলে উঠে, আপামনি আসি তবে। অবরুদ্ধ কান্না চেপে তপতী কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারে না। ঠোঁট দু‘টো শুধু কেঁপে উঠে। তপতীর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে নাহিদ হারিয়ে যায় রাতের আঁধারে।
’৭১ সাল, ডিসেম্বরের সাতাশ তারিখ। দিনটি ছিল সোমবার। সকাল বেলা একটি আর্মি জীপ তপতীদের বাড়ির সামনে থামলো। সামরিক পোশাক পরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ধীর পায়ে তপতীদের বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। মাথার ক্যাপটি খুলতেই তপতী চিনতে পারে নাহিদের বন্ধু অপুকে। নাহিদ আর অপু দু‘জনেই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ট্রেনিং প্রাপ্ত অফিসারদের প্রথম ব্যাচ। অপুর ছিল নাহিদের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে পড়ালেখা করেছে ওরা।
তপতীকে দেখে অপু হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু ওর হাসিটা কেমর জানি মলিন দেখালো। তপতীই প্রথম প্রশ্ন করে, কেমন আছিস অপু? নাহিদ কেমন আছে? কোথায় ও? দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শক্ত করলো অপু। তার বললো, হেডকোয়ার্টার থেকে এই চিঠি আর পার্শেলটা আপনাকে দেওয়া হয়েছে। তপতী কাঁপা হাতে সামরিক সিলমোহর লাগানো খাম আর পার্শেলটা হাতে নেয়। খামটা খোলার আগেই অপু বলে আমি আসি দিদি। তারপর হঠাৎই ড্রইং রুমে রাখা নাহিদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছবিটাকে সামরিক অভিবাদন জানিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
কাঁপা কাঁপা হাতে তপতী খামটা খোলে। তারপর ওর চোখের সামনে সামরিক অভিধানের অতিপরিচিত, চিরপুরাতন কথা ভেসে উঠে।
‘মেজর নাহিদ কিল্ড ইন অ্যাকশন অন দি টুয়েলভ অব ডিসেম্বর।’ সমস্ত পৃথিবী তপতীর সামনে থেকে হারিয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর আটচল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে থেমে থাকে নি তপতীর জীবন। থেমে থাকেনি নাহিদের প্রিয় বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ, মানুষের জীবনধারা। তপতীর বিয়ে হয়েছে। দু’টি বাচ্চাও আছে ওর। বড়টি ছেলে। নাম রেখেছে মুক্তি। আর ছোটটি মেয়ে নাম তাজীন মানে সাহসী।
তপতী চুপচাপ বসে ভাবছিল নানান কথা। ভাবছিল আটচল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের মাটি লাল হয়ে গিয়েছিল নাহিদের শহীদি রক্তে। নাহিদদের জন্যেই তো এ দেশ, এ মাটি আজ স্বাধীন। আবেগে আর অবরুদ্ধ অভিমানে তপতীর কণ্ঠ যনে রুদ্ধ হয়ে আসতে চায়। ওর হাতে এখন নাহিদের ডায়রিটা। তপতীর হঠাৎ মনে হয় নাহিদের মতো ছেলেরা মরতে পারে না। তা’হলে তপতীর মতো লক্ষ লক্ষ বোনের চোখের জলের কোনো মূল্য থাকবে না।
নাহিদের ডায়রির একটা পাতা থেকে তপতী আবৃতি করে-
“বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যতো মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা?
স্বর্গ কি হবে না কেনা… তবে ঘর হারা সবে
অন্তরের কি আশ্বাস রবে
মরিতে ছুটিছে শত শত
প্রভাত আলোর পানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মতো।”