সাম্প্রতিক প্রকাশনা

অদেখা অসত্য

Israt Sharmin Keya লেখাটি পড়েছেন 1226 জন পাঠক।
 জামাল সাহেব লেখালেখি করার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন তার ব্যালকনিকে। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি এই কাজটি করবেন বলে ভাবছিলেন। নিজের ঘরে বসে তিনি কখনওই নির্বিঘ্নে লেখালেখি করতে পারেন না। এই বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বাড়ির প্রধান সদস্য হল তার ছয় বছর বয়সী নাতি,অনি। এই নাতিটি তার একমাত্র মেয়ে শৈলীর সন্তান। শৈলী দীর্ঘদিন যাবত অনিকে নিয়ে বাবার বাড়ি থাকছে। তার স্বামী গত দেড় বছর ধরে নিখোঁজ। দেড় বছর ধরে যে মানুষটি নিখোঁজ, তার সাথে অনেক ধরনের ঘটনাই ঘটতে পারে। কিন্তু শৈলী তা মানতে নারাজ। তার ধারণা, তার স্বামী অন্য কাউকে বিয়ে করে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে কিন্তু যাওয়ার আগে তাকে মুক্ত করে যায় নি। তাই সে ডিভোর্স পেপার তৈরি করে গত এক বছর ধরে তার স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষা করছে। সে আসা মাত্রই শৈলীর প্রথম কাজ হবে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা চেয়ারে বসানো,তারপর তাকে দিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করিয়ে নেয়া। তার আকস্মিক এই নিখোঁজ হওয়ার কারণে গত এক বছরে তাকে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে,অনিকে বিভিন্ন সময়ে তার বাবার বিষয়ে কি কি জবাবাদিহি করতে হয়েছে তার একটা লিস্ট সে তৈরি করে রেখেছে। অনির বাবা আসা মাত্রই ডিভোর্স পেপার সাইন করানোর আগে তাকে লিস্টটি পড়ে শোনান হবে। মাঝে মাঝে শৈলীকে টেলিফোনে কার সাথে যেন উচ্চস্বরে কথা বলতে শোনা যায়। বিষয়টির একটা সমাধান এর জন্য থানায় জিডি করার পাশাপাশি সে এক উকিল এর কাছে নিয়মিত যাতায়াত করছে । 

জামাল সাহেব রিটায়ারমেন্ট এ গিয়েছেন তিন মাস হল। রিটায়ারমেন্টের পর তার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান থাকবে তার লেখালিখি নিয়ে এই বিষয়ে তিনি আগেই বাড়ির সবাই কে জানিয়ে রেখেছেন। তার স্ত্রী রাশেদা বেগম কারনে অকারনে কথা বলতে বেশ পছন্দ করেন। জামাল সাহেব অফিস থেকে আসা মাত্রই তিনি তার সারাদিনের গল্পের ঝুরি খুলে বসতেন। তার গল্পের বিষয়বস্তু থাকে খুবই হালকা,মেয়েলি গল্প যাদের বলে। পাশের বাসার শাশুড়ি বউ এর মধ্যে অশান্তি, দূর সম্পর্কের আত্মীয় এবার আম পাঠাবেন বলে জানিয়েছেন, অনি গ্লাস উলটে পানি না ফেলেই পানিভর্তি গ্লাস ধরে রাখার কৌশল শিখেছে কোথায় যেন,এই জাতীয় আলাপ। তিনি এ ধরনের গল্প শোনায় বিশেষ আগ্রহী নন,কিন্তু স্ত্রীকে তিনি অসম্ভব ভালবাসেন এবং তার মনে কষ্ট দিতে চান না বলেই হু হা জাতীয় উত্তর দিয়ে এইসব গল্পে অংশগ্রহন করতেন। এছাড়া তার স্ত্রী তার সাথে গল্প করবে না তো কার সাথে করবে। তবে শৈলী এ বাড়িতে এসে থাকা শুরু করার পর থেকে রাশেদা বেগম অনিকে নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পরলেন। তার দিনের অধিকাংশ সময় কাটে অনিকে ঘিরে। এতে করে জামাল সাহেব একটু নিশ্চিন্তে হলেন। লেখালিখি করার সময় রাশেদা এসে গল্পের ঝুলি খুলে বসবেন না। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়, অনির দুষ্টুমির যন্ত্রণায় মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল হল। হয়ত তিনি টেবিল চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন,অনি এসে চিৎকার করে ‘নানুভাই’ বলে পিছন থেকে তার ঘাড়ে ঝুলে পরবে এবং তাকে ঘাড় থেকে নামানো রীতিমত দুসাঃধ্য ব্যাপার। জামাল সাহেব এর বয়স হয়েছে,তিনি বেশিক্ষন অনির ভার সহ্য করতে পারেন না,তার কাঁধে ব্যথা শুরু হয়। রাশেদা বেগম অনির যাবতীয় দুষ্টূমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখেন। তার মতে, তার নাতি অসম্ভব বুদ্ধিসম্পন্ন এক শিশু। তার সকল দুষ্টুমির প্রতিভার সবচেয়ে বড় ভক্ত তিনি একাই। জামাল সাহেব তার দারোয়ান ফরিদ এর জন্য অপেক্ষা করছেন। সে এসে বেল্কুনির চারপাশে একটা গ্লাস শিল্ড বসিয়ে দিবে,টেবিল চেয়ার সেট করে দিবে ইত্যাদি । গ্লাস শিল্ড বসানোর কারন হল, বৃষ্টি এলে যেন তার প্রয়োজনীয় জিনিস প্ত্র ভিজে না যায় এবং একই সাথে তিনি প্রকৃতিও দেখতে পারেন। অনি এদিক টায় বেশি আসে না,কারন সে রেলিং ছাড়া বেল্কুনি ভয় পায়। এছাড়া এই জায়গা টা বাড়ির পিছন দিক বলে বেল্কুনির ঠিক সামনে আর কোন দালান নেই। দুইটা বড় আকৃতির কৃষ্ণচূড়া গাছ,একটা কাঠাল গাছ, আর মাঝে অসংখ্য কচুরিপানা ফুলে ভরা একটা ডোবা। এই জায়গাটিতে সম্ভবত একটা বিল্ডিং ওঠার কথা ছিল,কিন্তু কোন কারণে হয়নি। না হওয়াতেই ভাল হয়েছে,নাহলে তিনি লেখালিখি করার সময় দেখতে পেতেন সামনের বিল্ডিং এর রান্নাঘরে কেউ একজন রান্না করতে করতে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতে করে তার মনোযোগে ব্যঘাত ঘটবে। লেখালিখি করার জন্য মনোযোগ অপরিহার্য, মনোযোগ এ ব্যঘাত ঘটলে কোনভাবেই লেখালিখি করা সম্ভব না। জামাল সাহেব বসার ঘর থেকে মাটির সাঁড়শিতে রাখা দুটো মানিপ্ল্যন্ট গাছ এনে বেল্কুনির একপাশে ঝুলিয়ে রাখলেন। পেছনের দেয়ালে একটা সুন্দর তৈলচিত্র রাখা যেতে পারে। একটি সুন্দর তৈলচিত্র যেকোন জায়গার শোভা বৃদ্ধি করে। এছাড়া তৈলচিত্র শৌখিনতার পরিচয় বহন করে। তার চেয়ে বড় কথা হল, লেখালিখি করার জন্য একটা আবহ প্রয়োজন। আবহ না থাকলে লেখালিখি করা যায় না। চাকরিরত অবস্থাতেই দীর্ঘ সময় ধরে তার পরিকল্পনা ছিল,রিটায়ারমেন্টের পর তিনি পুরো দমে লেখালিখি শুরু করবেন। 
লেখক হওয়ার শখ তার বহু পুরনো। কিন্তু লেখক হওয়াকে তিনি জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে বেছে নেয়ার সাহস করেন নি। একজন লেখকের দু পয়সার আয় দিয়ে সংসার চালান কঠিন। তার বাবা ছিলেন, এক সরকারি অফিসের সামান্য পিয়ন। তার ছোটবেলার স্মৃতি সুখকর নয়। তাই তিনি সবসময় ঝুঁকি এড়িয়ে চলেন। জীবনে শখের চেয়ে বাস্তবতা কে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তাছাড়া একজন লেখকের জীবন পথ বেশ উঁচুনিচু,খানা খন্দে ভরা,স্থানে স্থানে পাহাড় পর্বত, মাঝখানে সাগর মহাসাগর। লেখক একবার পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে তাকে অবশ্যই সমুদ্রে পড়তে হয়। সেই সমুদ্র সাঁতরে পাড় করে আবার তীরে এসে পোঁছান দীর্ঘ সময়ের ব্যপার। 

শুধু জীবিকা নয়,জামাল সাহেব তার চলার পথে,অফিসে,রাস্তা ঘাটে যেখানেই কোন ঝামেলার আভাস পেয়েছেন,সেখান থেকেই নিরবে সরে এসেছেন। এমনকি রিক্সাওয়ালার সাথেও তিনি কোন প্রকার দামাদামি করেন না। রিকশাওয়ালা যা ভাড়া চায়,তাতেই তিনি রাজি হয়ে যান। বিশ টাকার জায়গায় ত্রিশ টাকা ভাড়া চাইলেও তিনি কথা বাড়ান না। এর ফলে, গুটি কয়েক রিক্সাওয়ালা তাকে চিনে ফেলেছে এবং তাদের প্রায় ই জামাল সাহেব এর বাসার নিচে অপেক্ষা করতে দেখা যায় এই আশায়,যদি তিনি কোথাও বের হন। কয়েক সপ্তাহ আগে এক রিক্সাওয়ালা রিক্সা চালাতে চালাতেই আগের রাতে তার মা মারার যাওয়ার কাহিনী শোনাল। তার মা মারা যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে পানি চেয়েছিল কিন্তু রিক্সাওয়ালা পানি নিয়ে আসার পর দেখে তার মা মৃত। মা মারা যাওয়ার আগে এক ফোঁটা পানি মা কে খাওয়াতে পারে নি সেই দুঃখে রিক্সাওয়ালা চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই কোন রকমে রিক্সা চালিয়ে জামাল সাহেব কে বাসায় নামিয়ে দিল। জামাল সাহেব এর বড় মায়া হল। তিনি তাকে ত্রিশ টাকার জায়গায় দুশ টাকা ধরিয়ে দিলেন এবং কি মনে করে যেন বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রিক্সাওয়ালা থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে জামাল সাহেব এর চলে যাওয়া দেখল। দুদিন পর,জামাল সাহেব বাজার থেকে ফেরার পথে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লক্ষ্য করলেন,সেদিনের সেই রিক্সাওয়ালা অন্য এক প্যসেঞ্জার কে বাজারে নামিয়ে দিয়ে হঠাত কান্নায় ভেঙ্গে পরল। তিনি কাছাকাছি ছিলেন বলে,শুনতে পেলেন,রিক্সাওয়ালাটি সেই দিনের তার মা মারা যাওয়ার হৃদয়বিদারক কাহিনী এই প্যসেঞ্জারটির কাছেও বর্ণনা করেছে। প্যসেঞ্জারটি দয়াপরবশ হয়ে তাকে একশ টাকা দিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিল। রিক্সাওয়ালাটি চোখ মুছে পকেটে টাকা রাখতে রাখতে হঠাৎ জামাল সাহেবকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল। জামাল সাহেব তাকে দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে সড়ে এলেন। শুধু শুধু একজন মানুষ কে লজ্জায় ফেলার প্রয়োজন কি। 

ফরিদ বেলকেনির চেহারা নিমেষেই পালটে ফেলল। কাঁচের শিল্ড এর কারনে যদিও একটা বাক্স বাক্স ভাব চলে এসেছে,তবুও খারাপ লাগছে না। ফরিদ টেবিল সেট করে একপাশে ছোট একটা বই এর শেলফ এনে রাখল। অন্য পাশে একটা পাতাবাহার গাছের টব রাখল। টেবিল এর এক পাশে পরিষ্কার পানিভর্তি একটা গ্লাস রাখা। চমৎকার পরিবেশ। ফরিদ একটা বেত দিয়ে বানানো ঝুরি এনে টেবিল এর পাশে রেখে বলল, -স্যার,এটা আপনের কাগজ ফেলানোর জন্য। লেখালিখি করবেন তো অনেক কাগজ ফেলানি যাইতে পারে। জামাল সাহেব চমৎকৃত হয়ে বললেন,বাহ,ফরিদ, তোমার বুদ্ধি তো ভালই। ফরিদ খুশি হয়ে বলল, স্যার পড়ালেখা করছিলাম কিছু। এইট পাশ,কালিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়, নওগাঁ। -বেশ তো। তুমি কি জান,লেখার সময় কাগজ কেন প্রচুর কাগজ খরচ হয়? -না স্যার, তবে একবার নাটকে দেখসিলাম এক লোক চিঠি লিখতে বইসা ক্ষণে ক্ষণে কাগজ ছুঁইরা ফালায়া বাসা ভরায় ফালাইছে। কি এক অপচয়। -ফরিদ। -জী স্যার। - লিখতে বসে কাগজ অপচয় হওয়া কিন্তু ভাল লক্ষণ। কিভাবে জান? -না স্যার। -তার মানে লেখক চেষ্টা করছে তার মাথার ভিতরে সাজান চরিত্রগুলোকে নিখুঁত ভাবে শব্দের মাধ্যমে সাজাতে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে সেই নিখুঁত ব্যপারটা অনুভব করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত কাগজের অপচয় হতেই থাকবে। এই অপচয় ভাল অপচয়। বুঝতে পেরেছ? -জী স্যার,বুঝতে পেরেছি। -আমার লেখক হওয়ার শখ বহুদিনের কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি একটা শব্দও লিখিনি। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না? 

-কেন লেখেন নাই স্যার? -আমি সঠিক সময়ের অপেক্ষা করেছি। এখন সময় এসেছে। এখন শুরু করব। এমন কিছু সাড়া জাগানো লেখা লিখব, যেন সবার মনে তাক লেগে যায়। ফরিদ উতসাহী কন্ঠে বলল,স্যার, কি বই ছাপাইবেন? -সেটাই উদ্দেশ্য। ফরিদ হাসিমুখে মাথা নাড়ল। স্যার এর সাথে কথা বলার সময় সে সবসময় হাশিমুখে থাকার চেষ্টা করে। কেন করে সে নিজেও জানে না। সে অনেক মানুষ দেখেছে ,তারা নিজেদের দুঃখ দুর্দশার সত্য মিথ্যা গল্প বানিয়ে স্যার এর সামনে কান্নাকাটি করলে স্যার তাদের মায়া করে বাড়তি টাকা পয়সা দেন। স্যার মানুষ টার মন মাখন এর মত নরম,পানির মত পরিষ্কার। এরকম একটা মানুষ কে ঠকিয়ে কিছু স্বার্থপর মানুষ সবসময় ব্যস্ত থাকে নিজের স্বার্থ হাসিল এর আশায়। এই বিল্ডিং এ আগে দু জন দারোয়ান ছিল,সে আর জয়নাল মিয়া। জয়নাল মিয়া স্যার এর সাথে দেখা হওয়া মাত্র তার জীবনের হাজারো অভাব অনটনের বিবরণ শুরু করে কান্নাকাটি করে স্যার এর কাছ থেকে অনেক টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। একদিন সকাল বেলা ফরিদ দেখল, জয়নাল মিয়া ব্যাগ আর তার সব মালপত্র গুছিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। ফরিদ তাকে জিজ্ঞেস করার পর সে হাই তুলতে তুলতে বলল, বাড়িতে পাকা ঘর তুলছি,আর দারোয়ান এর কাম করমু না। ফরিদ এর কিছু বোঝার বাকি রইল না। সে মূর্খ না, কালিগ্রাম উচ্চবিদ্যালয় থেকে এইট পাশ করা। আগেই সে আঁচ করেছিল এ ধরণের কোনকিছু ঘটবে। সে কোন কথা না বাড়িয়ে, সোজা স্যার এর কাছে চলে গেল নালিশ করতে। 

স্যার সব শুনে মুখের সামনে থেকে পত্রিকা সরিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ফরিদ তুমি জয়নাল কে কিছু বলো না। - আমি একটা টুঁ শব্দও করি নাই,স্যার, সিধা আপনের কাছে আসছি,আপনে নিচে চলেন,স্যার,শালারে আটকাইতে হইব, সাহস কত বড়। ফরিদ রাগে ফুঁসতে লাগলো। জামাল সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন, তাকে যেতে দাও। ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার মাথা খারাপ হইছে? এই বদমাইশ দিনের পর দিন বাটপারি কইরা এখান থেইকা পালাইতেসে, আপনেরে একবার জানায় পর্যন্ত নাই। জামাল সাহেব তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে ফরিদ কে দিয়ে বললেন, যাও, আজকে দুপুরে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেও। ফরিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তার নালিশ এর উদ্দেশ্য এটা ছিল না। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল তার। 

জামাল সাহেব চেয়ারে বসলেন। তার কল্পনায় ভেসে উঠল, এখানে বসেই তিনি একের পর এক সেরা লেখাগুলো লিখে যাবেন। তার মনে এক ধরনের ছেলেমানুষী আনন্দ হতে লাগল। যদিও তিনি আগে কোন গল্প উপন্যাসই লেখেননি, কিন্তু তাতে কি। 

সবকিছুরই একটা শুরু আছে। চাকরি আর লেখালিখি দুটো একসাথে চালানো সম্ভব না। চাকরিজীবিদের মাথায় নানা ধরণের চাপ থাকে,চিন্তা থাকে। চাকরি ছাড়া অন্য দিকে মনোনিবেশ করলে অনেক সময় সেটা চাকরি ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই যেমন তার কলিগ কাদের সাহেব গত বছর বই মেলায় একটা বই ছাপিয়ে দারুণ নাম ডাক কামালেন। গল্পটি ছিল একাত্তর এর পটভূমিতে লেখা এক পুলিশ অফিসার এর জীবন কাহিনী। যিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রাণভয়ে শুধু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে বেরিয়েছেন। দেশের প্রতি দায়িত্ব এবং মমত্ব বোধ থেকে দূরে থেকে তিনি কাপুরুষের পরিচয় দিয়েছেন যা পরবর্তীতে তাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করেছে। গল্পটি বেশ ভালভাবেই পাঠক হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিল। কিন্তু তাতে করে কাদের সাহেব এর প্রচুর সময় ব্যয় হয়েছে। ফলাফল স্বরূপ, তিনি সেই বছরের বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট থেকে বঞ্ছিত হলেন। অবশ্য সেদিকে কাদের সাহেব এর তেমন কোন ভ্রূক্ষেপ নেই,কারন তিনি অবিবাহিত। তার সংসার সম্পর্কিত যাবতীয় চিন্তা ভাবনা কম,কাজেই খরচও কম। তাকে অফিসের সবাই পাখি ভাই বলে ডাকে,কারন তিনি অফিসের সকলের মনে এক বিশ্বাস ঢুকিয়েছেন যে তিনি মুক্ত পাখির মত উড়ে বেরান। তার কোন পিছুটান নেই। বাকিরা সবাই খাঁচায় বন্দী বন্য প্রাণী। চাইলেও খাঁচা ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারবেন না। জামাল সাহেব বুঝতে পারেন না, খাঁচার ভিতর আশ্রয়, জীবন ধারণের সব উপাদান,পরিবার সবকিছু দেয়া থাকলে অকারণে বাইরে বের হয়ে উড়াউড়ি করার প্রয়োজন কি? 

আকাশ বেশ পরিষ্কার। মৃদু বাতাস বইছে। এখন বর্ষাকাল। যেকোন মুহূর্তে আকাশ কাল হয়ে বিমূর্ত রূপ ধারণ করে। এরপর শুরু হয় অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টি আগে জামাল এর বেশ অপছন্দের বিষয় ছিল। ইদানিং ভালই লাগে। জামাল সাহেব মাথার ভিতর গল্প তৈরি করা শুরু করলেন, চরিত্র গুলোকে সাজানোর জন্য বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করার চেষ্টা করলেন। এসময় রাশেদা বেগম এসে বেলকনিতে প্রবেশ করলেন। 

-বাহ,তুমি আমাকে ছাড়াই দেখি নিজের ছোট সংসার সাজিয়ে ফেলেছ। জামাল সাহেব চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এসেছ ভাল হয়েছে, আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যাও। চা ছাড়া মাথার ভিতর টা পরিষ্কার হয় না,চিন্তা গুলো জট পেকে থাকে। -এখন থেকে চায়ে এক চামচ চিনি পাবে,দু চামচ চিনি ডাক্তার নিষেধ করেছেন,মনে আছে তো? জামাল সাহেব এর মনে পড়ল, কয়েকদিন আগে তার সুগার বেড়ে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হয়েছিল। মাথা ঘুরে পড়ে আরেক্টুর জন্য হাত পা ভাংগা থেকে বেঁচে গেছেন। ডাক্তার তাকে কড়াভাবে যাবতীয় মিষ্টি জাতীয় জিনিস খাওয়া বারণ করেছেন। তিনি রাজিও হয়েছেন,কারন তার সুস্থ থাকা দরকার। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে লেখালিখির সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।কিন্তু এখন ব্যপারটা চিন্তা করে তার ভাল লাগল না। জামাল সাহেব বললেন, কি এক যন্ত্রনায় পড়া গেল, চায়ে চিনি কম দিয়ে খাওয়া আর চিরতার রস খাওয়া তো একই কথা। 

-এক চামচ চিনি হলে বল,নাহলে আমি গেলাম,অনির শরীর খারাপ করেছে, জ্বর। - জ্বর শুরু হল আবার কখন থেকে? -সকাল থেকেই। ঘুম থেকে উঠেই আজ তোমার ঘরে আসতেও পারে নি,খেয়াল করনি? জামাল সাহেব চিন্তা করে দেখলেন, আসলেও তিনি খেয়াল করেননি। বেলকনি সাজানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। জামাল সাহেব বললেন, সিজনাল জ্বর, ঠিক হয়ে যাবে। রাশেদা চা আনতে চলে গেলেন। তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। নাতির জন্য তিনি একটু বেশিই চিন্তা করেন। যেখানে চিন্তার প্রয়োজন নেই,সেখানেও তিনি অযথা চিন্তা করে নিজের ঘুম হারাম করবেন। একবার মশার কামড় এর বিস্তৃত দাগ কে তিনি কঠিন চর্মরোগ বলে দাবি করে তুলকালাম কান্ড করে ফেললেন। 

আজ সকাল থেকে জামাল সাহেব ভাবছেন,কাদের সাহেব এর লেখা বইটা নিয়ে একবার বসবেন। কাদের সাহেব নিজে তাকে বইটি উপহার হিসেবে দিয়েছেন। তিনি বইটি বাসায় এনে যত্ন করে শেলফ এ সাজিয়ে রেখেছেন,কিন্তু একবারও খুলে দেখেন নি। কাদের সাহেব বইটি দেয়ার সময় তাকে বলেছিলেন, জামাল সাহেব, গল্প- উপন্যাস লেখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি জানেন তো? জামাল সাহেব অনাগ্রহের সাথে জিজ্ঞ্যেস করলেন, কি? 

-চরিত্র গুলোকে সাজানো। চরিত্র গুলোকে হতে হবে আপনার ঘরের মানুষের মত। তাদের রক্ত মাংস এর গড়ন আপনার চেনা থাকতে হবে। তা’ নাহলে আপনি তাদের হাতে আনতে পারবেন না। জামাল সাহেব মাথা নাড়লেন। 

-লিখতে বসে মাঝে মাঝে দেখবেন, আপনার সৃষ্টি করা চরিত্র আপনার সাথেই কথা বলার চেষ্টা করছে। খবরদার,এদের কথায় কান দেবেন না। 

- ও আচ্ছা। -মাঝে মাঝে দেখবেন আপনি তাদের দুঃখ- কষ্টের কোন কথা লিখেছেন,এমন সময় তারা এসে আপনার কাছে অনুনয়-বিনয় করবে এই দুঃখ – কষ্টের অংশ টুকু মুছে দেয়ার জন্য, তারা সবসময় চাইবে আপনি তাদের নিয়ে সুখকর গল্প লিখেন। 
-আপনার ক্ষেত্রেও কি তাই হয়েছে? 

-না,আমি আপনার কথা বলছি,আমি তো মানুষ হিসেবে ভাল না। চরিত্রের কষ্টেই আমার সুখ। 

জামাল সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কাদের সাহেব বললেন, চলুন চা খেয়ে আসি। জামাল সাহবের কাদের সাহেবের সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে না, মানুষটি গায়ে পরে এসে তাকে উপদেশ দিচ্ছে। একটা বই প্রকাশিত হয়েছে বলে তিনি নিজেকে রাজা মহারাজা পর্যায়ে ভাবা শুরু করেছেন। জামাল সাহেব ভদ্রতার খাতিরে তাকে সরাসরি উপেক্ষাও করতে পারছেন না। কাদের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, চরিত্রের পিছনে যত সময় ব্যয় করবেন,গল্পের ভিত তত মজবুত হবে। এখনকার ছেলেপুলেরা কি করে জানেন তো নাকি? দুই রাতের মাথায় গল্প লিখে পান্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশনালয়ে হাজির। যেসব গল্প লিখে আনে, সেগুলো তাদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া সস্তা চুটকি প্রেমের উপন্যাস। এরপর শুরু হয় তাদের হাজারো নাটক। গল্প কেন নেবেন না, কেন ছাপাবেন না। আরে বাবা, এত কম সময়ে তুই লিখেছিস টা কি? তোর প্রেমিকার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাওয়ার গল্প? জামাল সাহেব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, তাহলে কি ভাই আপনি বলতে চাচ্ছেন, প্রেমের গল্প সাহিত্যের অংশ না? 

কাদের সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, সাহিত্য বোঝা সোজা কথা নয়, সাহিত্য গভীরের জিনিস। এখনকার ছেলেপুলেদের বয়স কম, আবেগপ্রবণ হয়ে লেখালিখিতে নেমে গেছে। গল্পে সাহিত্য নেই আছে শুধু বিনোদন। 

-বিনোদন থাকলে সমস্যা কোথায়। বিনোদন মানে আনন্দ, অধিকাংশ মানুষ আনন্দের জন্য গল্পের বই পড়ে, এতে ক্ষতি কি। 

-সাহিত্যের ক্ষতি। প্রতিটা চরিত্র হাতে ধরে তৈরি করার বদলে নিজের জীবন থেকে খাবলে এনে কিছু ঘটনা তুলে দিলেই হবে? হবে না। -তাহলে কি অটো- বায়োগ্রাফিকে আপনি সাহিত্য বলবেন না? কাদের সাহেব একটু বিরক্ত হলেন বলে মনে হল। জামাল সাহেব মনে মনে ঠিক করলেন তিনি আর কথা বাড়াবেন না। নিজের যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে কোন ঝামেলা বেধে যাক, তা তিনি চান না। চুপচাপ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। আর এসময় কাদের সাহেবের চাহিদা আকাশ্চুম্বি, তিনি যা বলেন সবাই বেদ বাক্যের মত তাই বিশ্বাস করে নেন। জামাল সাহেব কখনও কারও সাথে যুক্তি তর্কে জড়াতে চান না। এবারও তার ব্যতিক্রম করা ঠিক হবে না। 

জামাল সাহেব সেই বইটি শেলফ থেকে বের করে এনে বেলকনিতে এসে বসলেন। কাঁচের গ্লাস থেকে এক গ্লাস পানি পান করলেন। এরপর আচমকা ছুঁড়ে বইটি বাইরে ফেলে দিলেন। লিখতে বসে জামাল সাহেবের চায়ের তৃষ্ণা হল। তিনি রাশেদাকে খুজতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন অনির জ্বর বেড়েছে। সবাই তাকে ঘিরে ব্যস্ত। তিনি অনির কপালে হাত রেখে দেখলেন, কপাল পুড়ে যাচ্ছে, মারাত্মক তাপমাত্রা। রাশেদা বেগম এর মুখে আতঙ্কের ছাপ। শৈলী কোন এক ডাক্তারকে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় অনিকে নিয়ে হাসপাতাল এ যাওয়া অসম্ভব। শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডাক্তার 

ঢাকার বাইরে গিয়েছে, টেলিফোনেই শৈলীকে কিছু ওষুধ এর নাম লিখে দিল। আজকের মধ্যে জ্বর না কমলে আগামিকাল এই ওষুধগুলো এনে খাওয়াতে হবে। শৈলী ফোন রেখে কিছুক্ষণ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থেকে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই বাচ্চা ছেলেটার কথা একবারও কি তার মনে পড়ে না? ছেলের দায়িত্ব কি শুধু আমার একার? বাবা হিসেবে তার কোন দায়িত্ব নেই? শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়? রাশেদা বেগম নিচু গলায় বললেন, মা চেঁচামেচি করিস না, নানাভাই ঘুমোচ্ছে। 

-কেন চেঁচামেচি করব না, সবসময় আমাকে কেন চুপ থাকতে হবে? বাবা? তুমি কিছু বলছ না কেন? লোকটাকে খুঁজে বের করার কোন চেষ্টাই তোমার মধ্যে নেই? তোমারই তো সবচাইতে পছন্দের মানুষ ছিল সে? এখন কেন তুমি এত নিরব? জামাল সাহেব চুপ করে রইলেন। 

-আর কতদিন আমি এভাবে একা একা সংসারটাকে টানব? লোকটা মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে সেই খবর টা তো অন্তত আমাকে এনে দিতে পার তোমরা? পার না? জামাল সাহেব নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার বাম পায়ের সর্বকনিষ্ঠ আঙ্গুলের নখটি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়টি তিনি আগে লক্ষ করেন নি। এটা কি কোন ধরনের রোগ নাকি বয়সের কারনণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ক্ষয় ধরেছে? 

শৈলী বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাদের পছন্দে বিয়ে করাই আমার ভুল হয়েছে। সারাজীবন তোমাদের আদর্শ সন্তান হয়ে থাকতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছি। 

জামাল সাহেব তার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলেন, আচ্ছা শৈলীকে নিয়ে কিছু লিখলে কেমন হয়। স্বামী নিখোঁজ হওয়া এক নারীর জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প। জামাল সাহেব ঠিক করে ফেললেন, এই নিয়ে তিনি বিস্তারিত ভাববেন। শৈলী একা একাই কিছুক্ষণ খুব হইচই করল। 

-আমি একশ ভাগ নিশ্চিত সে বিদেশে গিয়ে নতুন করে ঘর করছে। তার অতীত জীবন সে মাটি চাপা দিয়ে গেছে। তার পিছন ফিরে তাকানোর আর প্রয়োজন নেই। আরে বাবা, তার যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা সেখানে যাক, জাহান্নামে যাক,তাতে কারও কিছু আসে যায় আসে না। কিন্তু এই ছেলেটাকে আমি কি জবাব দিব? সে আরও বড় হবে, বাবার খোঁজ জানতে চাইবে আমি তাকে কি বলে স্বান্তনা দেব? মা,তুমি অনির কপালে আইস ব্যাগ চেপে রেখেছ কেন,সরাও ওটা,জ্বর এর সাথে আবার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। 

জামাল সাহেব এর মাথা ঝিমঝিম করছে। তিনি বেলকনিতে এসে দাঁড়ালেন ,আকাশ মেঘলা। যেকোন সময় অঝোরে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি কোন কোন লেখকের জন্য ভাল লক্ষণ। বৃষ্টির সময় লেখালিখি করার অন্যরকম একটা আকাঙ্খা তৈরি হয়। সেই আকাঙ্খা থেকে জন্ম নেয় কালজয়ী সব চরিত্র। সম্ভবত তিনি কোন একটি বইয়ে এমনটি পরেছিলেন। তিনি প্রায়ই নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান থেকে ‘লেখক হবার ১০১ টি উপায়’, ‘দুই দিনেই হতে পারেন খ্যাতিমান লেখক’ এই জাতীয় বই কিনে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। কিছু কিছু বই তিনি অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরে শেষ করেছেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠা তিনি পুরোটা মুখস্ত করে রেখেছেন। কখন কোন কৌশল কাজে লাগে বলা যায় না। অফিসের সবাই সেখান থেকেই আস্তে আস্তে তার গোপন শখের কথা সম্পর্কে জানতে পারলেন। একবার তার এক কলিগ মনসুর সাহেব তাকে বলে বসলেন, তিনি যেন তার তার প্রথম লেখাটি মনসুর সাহেব এর ভাতিজি, সুপ্রিয়ার নামে উৎসর্গ করেন। সর্ব প্রথম জামাল সাহেবের মাথায় যে চিন্তাটি এল তা হল, তিনি যতদুর জানেন মনসুর সাহেবের নিজের তিন মেয়ে আছে। তিন মেয়ের কোনটির কথাই উল্লেখ না করে তার ভাতিজির নামে কেন তিনি লেখা উৎসর্গ করতে বললেন। দ্বিতীয়ত, জামাল সাহেব ইতিমধ্যে ঠিক করে রেখেছেন,তার প্রথম লেখাটি তিনি অনির বাবা,তার মেয়ের জামাই, শাহেদকে উৎসর্গ করবেন। 
মনসুর সাহেব মানুষটি অদ্ভুত। তিনি মাঝে মাঝে এমন্ সব কথা বলেন যার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেতে সকলের বেগ পেতে হয়। 

গত তিন দিন ধরে জামাল সাহেব একটি শব্দও লিখতে পারেন নি। কোথায় যেন কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। তিনি ঘণ্টার পর ঘন্টা মূর্তির মত টেবিল চেয়ারে বসে থাকলেন। কিন্তু খাতায় কোন লেখা তুলতে পারলেন না। আজ সকাল থেকে তিনি নাস্তা না করেই বেলকনিতে এসে বসে আছেন। কৃষ্ণচূড়া গাছ দুটোতে ঝাঁকে ঝাঁকে রক্তবর্ণের ফুল ধরেছে। এত ফুল একসাথে ফুটতে তিনি আগে কখনো দেখেন নি। রাশেদা বেগম একবার এসে বলে গেলেন, অনির জ্বর আরো বেড়েছে। তিনি রাশেদাকে বললেন, তাকে এক কাপ চা দিয়ে যেতে। রাশেদা খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, অনি কে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা কর,চা পরে খেলেও চলবে। তিনি রাশেদাকে ডেকে বললেন, রাশেদা, একটা জিনিস দেখে যাও। রাশেদা এগিয়ে এলেন। তার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ভারী ছাপ পরেছে। মনে হয় গত কয়েক রাত না ঘুমোনোর কারণে তার চোখ কোটোরাগত হয়ে গিয়েছে। জামাল সাহেব কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে দেখিয়ে বললেন, কি সুন্দর ফুল ধরেছে দেখ, এত লাল ফুল আগে কখনো দেখি নি। রাশেদা অবাক করা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই বর্ষাকালে কৃষ্ণচূড়া ফুল ধরবে কিভাবে? তোমার বিবেক দেখে আমি অবাক হয়ে যাই, তোমার নাতি গত কয়েকদিন ধরে জ্বরে কাবু হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, আর তুমি আমাকে ডেকে ফুল দেখাও। 

-এসব সামান্য জ্বর-ঠান্ডা এ বয়সী সব বাচ্চাদের হয়। 

-তুমি এটাকে সামান্য জ্বর বলছ কিভাবে? গত ৪ দিন ধরে টানা ১০৪ ডিগ্রী জ্বর। পানিটা পর্যন্ত খেতে পারছে না। যা খায় বমি হয়ে যাচ্ছে, তোমার কাছে এটা ছোটখাটো জ্বর? 

-তুমি কি মনে কর না অনিকে নিয়ে তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি কর? 
রাশেদা প্রায় ভাঙ্গা গলায় বললেন, তুমি গত ৪ দিনে ক’বার বাচ্চাটার কাছে গিয়েছ? ক’বার তার কপালে হাত রেখেছ? ক’বার তাকে একটু মুখে তুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছ? জামাল সাহেব চুপ করে রইলেন। 

-আমার কি মনে হয় জানো? শৈলী এ বাড়িতে থাকুক এই ব্যপারটি তোমার আর সহ্য হচ্ছে না। 

-উদ্ভট কথা বল না,রাশেদা। 

-আমি উদ্ভট কথা বলছি না,যদি কেউ উদ্ভট কথা বলে থাকে কেউ, তবে সেটা তুমি। -মেয়ের সাথে সাথে তোমার মাথাটাও গেছে। -অনির শরীর ঠিক হোক,আমি শৈলীকে নিয়ে আলাদা কোথাও গিয়ে থাকব। বিবাহিত মেয়ে তোমার ঘাড়ে চেপে বসেছে, বিষয়টি তোমার কখনওই পছন্দ ছিল না। কখনো মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে কথা বল না। লেখালিখি নিয়ে তোমার বাড়াবাড়ির সীমা নেই, কিন্তু মেয়ে আর নাতির অস্তিত্ব তোমার কাছে কোন মূল্য রাখে না। জামাল সাহেবের মাথা আবারো ঝিমঝিম করছে। রাশেদা বেগম সহজে রাগ হন না। তিনি বুঝতে পারলেন না ফুল দেখতে বলায়, সে এত উত্তেজিত হয়ে গেলে কেন। 

জামাল সাহেবের চায়ের তৃষ্ণা বেড়েছে। যা পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে এ বাসায় কারও কাছে এই মুহূর্তে চা পাওয়া যাবে না। এক কাজ করা যায়। বাইরে গিয়ে চা খেয়ে আসা যায়। তাতে কারো কোন বাঁধা নেই। তিনি একটা সাদা পাঞ্জাবি বের করলেন। কেন যেন আজ তার পাঞ্জাবি পড়তে ইচ্ছা করছে। তিনি ঠিক করলেন, সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর রাশেদাকে নিয়ে রিক্সায় করে ঘুরবেন। রাশেদা বেগুনি রঙের শাড়ী পরবেন, তিনি পরবেন সাদা পাঞ্জাবি। তারা দুজন মিলে পুরনো দিনে ফিরে যাবেন। গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রিক্সা করে ঘুরবেন। রাশেদার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করবে। সে আবার খুব অল্পতেই খুশি হয়। আজকালকার ছেলে মেয়েদের খুশি করা বড় কঠিন। সময় কাটাতে দামী রেস্টুরেন্ট না নিয়ে গেলে অভিমানে প্রেমিকার মুখ ভার হয়। কিন্তু আগেকার দিনে ঘন্টার পর ঘন্টা এক বাদামের প্যকেটে হাসতে খেলতে পার হয়ে যেত প্রেমিক প্রেমিকার মধুর সময়। শৈলী টেলিফোন হাতে ঘরময় পায়চারি করছে। জামাল সাহেব চোখ নামিয়ে বের হয়ে গেলেন। 

শৈলীর স্বামী শাহেদ তার অসম্ভব পছন্দের একজন মানুষ। তিনি শাহেদের মধ্যে নিজের বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাকে নিয়ে তিনি ঘন্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন আলাপ করে কাটিয়ে দিতে পারতেন। তার কখনোই মনে হয়নি ছেলেটি তার অর্ধেক বয়সী নিজের মেয়ের স্বামী। একমাত্র শাহেদই তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারতো। প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন একজনকে প্রয়োজন যে তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারে। বেশির ভাগ মানুষ এই একজনকে তার জীবনসঙ্গী অথবা প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু এই একজনকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে যেকোন মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে খুবই অপ্রত্যাশিত কারও মধ্যে। জীবনে কেউ কেউ এই একজনকে পেয়ে যায়, কেউ আবার পেয়েও হারিয়ে ফেলে। আজ শাহেদ থাকলে জামাল সাহেবের লেখালিখি শুরু করতে না পারার কারণ গুলো খুঁজে বের করে ফেলতে পারত। 

শাহেদের কথা তিনি ভাবতে চান না। এ নিয়ে ভাবলেই চোখের সামনে তার চেহারা ভেসে উঠে। সেই চেহারা স্বাভাবিক মানুষের না, একজন মৃত মানুষের চেহারা। জামাল সাহেব গত এক বছরে সরাসরি শৈলীর চোখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলেন নি। শৈলীর সাথে চোখ মেলালেই তার প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে, মেয়েটি তার চোখের ভিতর দিয়ে এই দৃশ্য দেখে ফেলবে। শাহেদ মারা গেছে, আজ থেকে এক বছর আগে। এই তথ্যটি জামাল সাহেব ছাড়া এই পরিবারের আর কেউ জানে না। কেউ যেন কখনও না জানতে পারে সে বিষয়ে তিনি সব ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। পুলিশকে বলা হয়েছে শাহেদের মৃতদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দিয়ে দেয়ার জন্য। পুলিশ সে মোতাবেক কাজ করেছে। কাজেই, শাহেদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। 

ঘটনাটি ঘটে এভাবে,গত বছর বই মেলায় কাদের সাহেব এর বই প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হল। তার কিছুদিন পর এক গোপন সূত্রে জামাল সাহেব জানতে পারলেন, বইটি কাদের সাহেব এর নিজের লেখা নয়। তিনি সুদূর ঝালকাঠি জেলার নবগ্রামে বাস করা অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ এক স্কুল হেড মাস্টারের কাছ থেকে লেখাটি চুরি করেছেন। এই তথ্যটি কতুটুকু সত্য এই নিয়ে অফিসে বেশ কয়েকদিন ব্যাপক কানাঘুষা চলল। কিন্তু বরাবর এর মত কাদের সাহেব বিভিন্ন অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে সবার কাছে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করালেন, তিনি তার বইয়ের একচ্ছত্র লেখক। 

জামাল সাহেবের মনে সন্দেহ রয়ে গেল। তিনি বিষয়টি শাহেদ এর সাথে আলোচনা করলেন এবং বললেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তিনি একবার ঝালকাঠি তে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে দেখে আসবেন। শাহেদ একটু আপত্তির সুরে বলল, কি দরকার, বাবা। গিয়ে যদি দেখা যায় তথ্যটি ভুল? আসলে এমন কিছুই নেই। জামাল সাহেব বললেন, বিষয় সেটা না। সত্যটা বের করা জরুরি, কাদের সাহেব যদি আসলেই গল্পটি চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেন তাহলে তিনি মহা অন্যায় করেছেন। এই অন্যায়ের শাস্তি হওয়া উচিত। শাহেদ সহমত পোষণ করল, ঠিকই বলেছেন, বাবা। তবে কাজটা কিন্তু বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ধরুন, আপনি আসল লেখকের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে পেলেন, এরপর ফিরে এসে কাদের সাহেব এর মুখোশ উন্মোচন করা থেকে শুরু করে আপনার প্রতিটা পদক্ষেপ কিন্তু নানান রকমের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আপনি কখনও এ ধরণের ঝুঁকি নেবেন, আমি ভাবি নি। আপনি সবসময় ঝুঁকি এড়িয়ে চলেন। 
জামাল সাহেব একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু জীবনে একবার না হয় একটু ঝুঁকি নিয়েই দেখি। এত নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের কোন আনন্দ নেই। আজ আছি কি কাল নেই। -তা ঠিক বলেছেন। তবে আমার কি মনে হয় জানেন?

 -কি? -আপনি কোন একটা কারনণ আপনার কলিগ কাদের সাহেবকে পছন্দ করেন না। সেটা হতে পারে দুটো কারণে। - কি কারণ? - এক, একজন মানুষ অন্য একজন মানুষ এর ক্ষতি করলে অথবা করার চেষ্টা করলে। দুই, একজন মানুষ এর মধ্যে অন্য একজন মানুষকে নিয়ে ঈর্ষাবোধ সৃষ্টি হলে। 

-আমার মনে হয় আপনার সাথে দ্বিতীয় কারণটি ঘটেছে। 

-তোমার তাই মনে হয়? -আমি আপনাকে আরও ভেঙ্গে বলছি। আপনার মধ্যে কাদের সাহেবকে নিয়ে ঈর্ষাবোধ জাগ্রত হয়েছে। এই ঈর্ষাবোধ এর কারণ টাও আমি ব্যাখা করি। লেখালিখি করা এবং লেখক হওয়ার শখ আপনার জন্য বহু পুরোনো। এই বিষয়টি আপনার ক্ষেত্রে শখের চেয়ে বেশি ,যাকে বলে ‘অবসেশন’। আপনার মধ্যে তাই এক ধরনের ঘোর কাজ করে,লেখালিখি নিয়ে যা কিছু হবে তা সর্বপ্রথম আপনাকে ঘিরে হবে। যার কারণে আপনি আপনার সমকালীন কাউকে এই জায়গাটিতে আপনার আগে প্রবেশ করতে দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। এই মনঃক্ষুণ্ণতা থেকেই আপনার ভিতরে সুপ্ত এক ধরনের ঈর্ষাবোধ তৈরি হয়েছে। 

জামাল সাহেব অবাক হয়ে গেলেন। ছেলেটি কি দারুণ বুদ্ধিমান। তিনি এই যুক্?

পাঠকের মন্তব্য


একই ধরনের লেখা, আপনার পছন্দ হতে পারে

bdjogajog