স্বাধীনতার মত শুদ্ধ আর কোন শব্দ নেই
যদি তার সম্মান দিতে পারি,
ভালবাসার মত আর কোন সুন্দর নেই
যদি তার মর্যাদা দিতে পারি,
জীবনের মত বিকশিত আর কিছু নেই
যদি জীবনে ফুল ফোটাতে পারি।
পঞ্চম পর্ব
জেনেভা ক্যাম্প। ঢাকার মোহাম্মপুরে এইমাত্র লিন্ডাকে নিয়ে পারভেজ রিক্সা থেকে নেমেছে। জেনেভা ক্যাম্পে বিহারীরা থাকে। বাংলাদেশের অস্থিত্ব তারা কোনদিনই মেনে নিতে পারতো না। নিজেদের ‘স্ট্রান্ডার্ড পাকিস্তানী’ বলে তারা মনে করতো। আদর্শ পাকিস্তানী তারা! তা’হলে খোদ পাকিস্তানে যারা আছে তারা কি? বিশাল একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দেয় পারভেজের মনে। এ সময়ই তার চোখ দুটো অবাক একটা ঘটনার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
এক বিহারী তরুণ পান-বিড়ি বিক্রেতার কাছ থেকে সিগারেট কিনছে হুইল চেয়ারে বসা এক মধ্যবয়সী মুক্তিযোদ্ধা। কে বলবে ৫০ বছর আগে এই মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ঐ নতুন প্রজন্মের বিহারী তরুনটির বাবা অথবা ভাই যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানী শরিয়ত হেফাজত করার জন্যে! লিন্ডার প্রশ্নে পারভেজ চমকে উঠে।
- ‘ইজ ইট জেনেভা ক্যাম্প, পারভেজ?
- ‘ইয়েস ইট ইজ।
- ‘এরা এতো খারাপ অবস্থায় থাকছে কিভাবে? ‘আই কান্ট বিলিভ মাই ওন আইস’। ‘হোয়াট আ’ লাইফ দেয়ার লিভিং’
- বাট দিস ইজ দ্যা রিয়েল লাইফ, লিন্ডা’
- ক্যাম্পের ভেতর যাবো আমি’, এনি প্রবলেম’
- ‘নো’ লেটস গো, লিন্ডা’।
- ক্যাম্পের লোকজন বিদেশী দেখে কৌতূহলী হয়। বিদেশী সাংবাদিক ভেবে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠে। লিন্ডা তার ক্যামেরায় বেশ কয়েকটি ছবি তোলে। কয়েক জনের সাক্ষাৎকার নেয় লিন্ডা। পারভেজ এ সময় গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। লিন্ডা গ্রে কেন এসেছে বাংলাদেশে সেটা এখনও পরিষ্কার নয় পারভেজের কাছে। জাফর অবশ্য বলেছে লিন্ডা টুরিস্ট ভিসায় আসলেও শুধু নির্দিষ্ট একজন বাংলাদেশীকে খুঁজছে। মানুষটা একজন মুক্তিযোদ্ধা। নাম রায়হান। রায়হানের শেষ অবস্থান ছিলো ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রে। তারপর সে কোথায় গেছে জানা যায়নি। রায়হানদের গ্রামের বাড়ি ঢাকার হরিরামপুরে সে কিছুদিন ছিলো। কিন্তু তারপর কোথায় চলে যায় তা কেউ বলতে পারে না। লিন্ডা একদিকে খুঁজছে রায়হানকে, অন্যদিকে সে সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে আর মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে। রায়হানের সঙ্গে কি এমন সম্পর্ক লিন্ডার? লিন্ডা এক বৃদ্ধ বিহারীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়ায় পারভেজের চিন্তায় বাঁধা পড়ে।
জেনেভা ক্যাম্পে বৃদ্ধ হাসান লিন্ডাকে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জানালেন,‘পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান তারা। এ দেশ তাদের নয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। খুবই দুঃখের মধ্যে দিন কাটছে তাদের। তরুণরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গের মিশে যেতে চায়। যত সময় যাবে নেতৃত্বের পরিবর্তন আসবে। আর তখন নতুন প্রজন্মের মানুষগুলো হয়তোবা এদেশেই থেকে যেতে চাইবে। তবে উর্দু ভাষা নিজেদের মধ্যে বলবেই। লিন্ডার কোমরে বাঁধা ক্যাসেটে টেপ হয়ে যাচ্ছিল হাসানের বক্তব্য। আর তাই হাসানের প্রশ্ন,
- ‘ আর ইউ অ্যা জার্নালিস্ট’? ফর্ম হুইচ কান্ট্রি?’
- ‘লিন্ডা বলে,‘জার্মানী’।
বৃদ্ধ হাসানের চোখ দু’টো ছোট হয়ে আসে। বয়স তার নব্বইয়ের ওপর। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, হিটলার, বার্লিন প্রাচীর সব, সব স্মৃতি তোলপাড় করে বৃদ্ধের চোখের সামনে ভেসে উঠলো একে একে। বার্লিন প্রাচীর আজ ভেঙ্গে গেছে। দু’জার্মানীও এক হয়েছে। কিন্তু পূর্ব -পশ্চিমের ব্যবধান কি কমেছে। এই প্রশ্নটাই লিন্ডাকে করে বৃদ্ধ। লিন্ডা বিব্রত হয়। এভাবে এ ধরণের সরাসরি প্রশ্ন এই প্রথম। উত্তর সত্যিই জানা নেই লিন্ডার। লিন্ডা জানে তার নিজের দেশের মানুয়গুলো আজও পূর্ব জার্মানীর মানুষকে আপন করে নিতে পারে নি। তা’হলে কিসের আশায় বাংলাদেশের বিহারীরা ফিরে যেতে চায় পাকিস্তান? এক সময় করাচীর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। মহাজির কওমি মুভমেন্টের আলাদা জাতিসত্তার আন্দোলন সারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্বিত্বকে বিপন্ন করে দিয়েছিল।
সেই ’৪৭ সালের কথা। ভারত ভাগ হবার পর থেকেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। ’৪৭ এর পর ধর্মের ভিত্তিতে যখন ভারত- পাকিস্তান জন্ম নিল, হিন্দু-মুসলিমে দাঙ্গা লাগলো, তখন উর্দুভাষী ভারতীয় মুসলমান অর্থাৎ মহাজিররা বিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। মহাজির হিসেবে স্থান পায় এদেশে। কিন্তু ভারত স্বাধীন হবার পর মহাজিররা আত্নপরিচয়ের সংকটে পড়ে। তারা না হতে পারে পাকিস্তানী, না হতে পারে ভারতীয়। বাঙালি পূর্ব পাকিস্তানীদের তারা মন থেকে মেনে নিতে পারে না। এভাবেই শুরু হয় তাদের আত্নাভিমানের পালা। আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের উর্দূ ভাষাভাষীরা নিজেদের বাংলাদেশী ভাবতে অস্বীকার করে ‘আর্দশ পাকিস্তানীর রূপ নেয়। পাকিস্তান আজও তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় নি। ত্রিশ বছর ধরে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে রয়ে গেছে। রাজনীতির কি নিষ্ঠুর প্রতিশোধ! তবে ২০০৩ সালের হাইকোর্টের এক রায় অনুযায়ী ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের বিহারিরা বাংলাদেশী। তরুণ বিহারীরা এই রায়ের জন্য উচ্ছ্বসিত, কিন্তু অনেক বয়স্ক মানুষ তরুণ প্রজন্মের উৎসাহে হতাশ হয়ে পড়েছে।
পারভেজ- লিন্ডা একসময় জেনেভা ক্যাম্পের বাইরে এসে দাঁড়ায়। ঢাকার আকাশে তখন অস্তগামী সূর্য। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তায় তাই পানি জমেছে। রাস্তার ওপর পেঁয়াজ দিয়ে বিশেষ ধরণের কাবাব ভাজা হচ্ছে। সেই চুলার গনগনে আগুনের আঁচ এসে লাগছে লিন্ডার গালে। বিন্দু বিন্দু ঘামের আভা তার কপালে, গালে, সারা মুখে। পাশেই একটি বিরাট কড়াইতে জিলাপি ভাজা হচ্ছে। সব মিলিয়ে চারপাশে অদ্ভূত একটি গন্ধ। ঢাকা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন শহরে এমনটি দেখা যাবে না হয়তো। ঢাকার আলাদা রূপ লিন্ডাকে কেন যেন আনমনা করে দেয়। অনেক বিচিত্র ও ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এ শহর। হয়তোবা ভবিষ্যতেও হবে।
ঢাকার ইতিহাস। প্রাচীন ইতিহাস। কত কথা। কত ভাবের সমাবেশ। ঢাকার কাহিনী যেমন বৈচিত্রময়, তেমনি রোমাঞ্চকর। ঢাকা বরাবই এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বন্দর হিসাবে খ্যাত ছিল। ঢাকার মসলিনের খ্যাতি ছিল অনাদিকাল থেকে। মিসর, তুর্কী, ইরান, ইরাক, রোম, ইংল্যান্ড, সিংহল, গ্রীস ও বার্মায় ঢাকা থেকে গুড়, মসলা রফতানি হত। ঢাকা ছিল তখনকার দিনে আজকের সিঙ্গাপুরের মত আন্তর্জাতিক ফ্রি পোর্ট। ঢাকার বিকাশ শায়েস্তা খানের আমলেই ঘটে। তার আমলেই বিরাট সংখ্যক ইমারত, পাকা রাস্তাঘাট তৈরি হয়। আজকের ঢাকা সে অতীতের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে- তার বয়স অনেক পুরাতন, অনেক প্রাচীন। সেই প্রাচীন ঢাকা ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অন্যরূপ নিয়েছিল। অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা আর স্বপ্নে বিভোর ছিল ঢাকার মানুষ। তবে সবাই নয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষত মীরপুর, মোহাম্মপুরের ‘বিহারী নামধারী মোহাজেররা তাদের আস্ফালন, উদ্ধত আচরণ, বেপরোয়া লুণ্ঠন, হত্যা এবং নিরীহ লোকজনের ওপর উস্কানী দিয়ে পাকিস্তানী আর্মিকে লেলিয়ে দিয়ে নিজেদের অমানবিক স্বার্থ চরিতার্থ করতো।
এই ঢাকাই ‘৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্নসর্মপণ অবলোকন করেছে। দেখেছে ‘৭৪ এর দুর্ভিক্ষ। দেখেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকাণ্ড। দেখেছে ৭ নভেম্বরে খোন্দতার মুশতাককে কোলে করে উচ্ছল ঢাকাবাসীর মহা আনন্দ প্রকাশ। ঢাকার মানুষগুলোর দুর্ভাগ্য ঢাকা শহর কথা বলতে পারে না। যদি পারতো ত’তা’হলে ঢাকা শহর অনেক কথা বলতো, যা ইতিহাসে লেখা হয় না। যা কোন গল্প- কবিতা-উপন্যাসে স্থান পায় না। ঢাকা আরও অনেক কিছু দেখবে। মানুষগুলোও নানা ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা নেমে রাত গভীর হবে। আবার সকাল হবে। কিন্তু এই জনপদ থেকে যারা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে তারা কোনদিনই আর ফিরে আসবে না। তবু ঘটনাপ্রবাহ থেমে থাকবে না। থেমে থাকে না তা কখনও। ঢাকা শহর নিজেই তো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। ঢাকার আদি লোকালয় বলতে ফরাশগঞ্জ,সূত্রাপুর লক্ষীবাজার, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার বোঝাতো। আজ গুলশান, বারিধারা, উত্তরা অন্য এক ঢাকা হয়ে গেছে। এমন কি একসময়ের বিহারী অধ্যুসিত মোহাম্মদপূর ও মিরপুর। এ অঞ্চলের তরুণ- তরুণীদের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের তরুণদের কোন মিল নেই। ঢাকা এখন ফাস্টফুড, ডিস অ্যান্টেনা, শপিং কমপেক্স, শপিং মল, চায়নিজ এবং সাইবার ক্যাফে আর কফি শপের শহর।
রাজধানী ঢাকার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হয় না মুক্তিযুদ্ধ। ৫০ বছর আগের অতীত সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে ক্ষমতা লোভী রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবিদের কারণে। নিজেদের উদ্দেশ্যহীন কাজের মাধ্যমে এসব নেতারা তরুণদের কাছে প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করে তুলছে। নানা মহল মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে তুলে ধরছে।
তাই পারভেজ ভাবে আসলে সে কে? কিভাবে এ দেশের মাটির কোলে সে এসেছে তাতো কেউ জানে না। জানলে কি তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতো? না’কি চরম ঘৃণায় নাক কুঁচকাতো?
‘লেটস্ হেভ অ্যা কাপ অফ টি’- লিন্ডার কথায় পারভেজ তার লাগামহীন চিন্তার জগৎ থেকে চা’য়ের জগতে ফিরে আসে। ঢাকার রাস্তারধারের চা’য়ের দোকানের চা লিন্ডা মাত্র একদিনেই লাইক করে ফেলেছে খুব। মোটামুটি ভিড় কম দেখে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে লিন্ডাকে নিয়ে বসে পড়ে পারভেজ। চা খেতে খেতে রিন্ডা তার পরবর্তী পরিকল্পনার কথা জানায় পারভেজকে। রায়হানের গ্রামে যেতে চায় লিন্ডা। সেখানেও কোন খবর পাওয়া না গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম যেতে চায় সে। লিন্ডার সবশেষ পরিকল্পনায় পারভেজ অবাক ও সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেখানে কোন বিদেশীকে যাবার পারমিশন যে সরকারের স্পেশাল এ্যাভেয়ার্স বিভাগ দিবে না তা পারভেজ জানে। কিন্তু লিন্ডা তা জানে কি? (চলবে)
[ধারাবাহিক উপন্যাস ‘দুই নগরের উপাখ্যান ’ রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। উপন্যাসের চরিত্রসমূহ কাল্পনিক। কোন জীবিত বা মৃত মানুষের জীবনের সাথে এর কোন সাদৃস্য পাওয়া যাবে না। পটভূমি ঐতিহাসিক হওয়াতে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাসের সঙ্গে হুবহু মিল নাও পাওয়া যেতে পারে।]