উৎসবের নামে উন্মাদনা বন্ধ হউক
শেষ পর্যন্ত শিশু উমায়ের মারা গেল। তার চিকিৎসা চলছিল মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। মায়ের পেট থেকেই সে হৃদপিণ্ডে ছিদ্রসহ জন্ম নিয়েছিল। চিকিৎসাও চলছিলো। কিন্তু চারপাশের প্রতিকূল পরিবেশ তাকে অস্ত্রপ্রচার পর্যন্ত আর বেঁচে থাকতে দিল না। ঢাকা শহরব্যাপী আতশবাজি, পটকা ফাটানো প্রচন্ড শব্দে ভীত হয়ে পেনিক ডিজ অর্ডারে সে মারা গেছে।
সম্প্রতি ২০২২ নববর্ষ উদযাপনের উন্মদনায় কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আমারা সারা ঢাকা শহরব্যাপী আতশবাজি, পটকা ফাটানো ও ফানুস উড়ানোর যে বাঁদর নাচ নাচি তা’কি আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত? বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে এই উন্মুক্ত উদযাপন কী কোনোভাবে খাপ খায়? এই উদযাপন যেমন পরিবেশের ক্ষতি করেছে, তেমনি ঢাকা শহরে বসবাসরত বিভিন্ন পাখিদের জীবনাচরনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শালিক, চড়াই, কাক, আবাবিল, পায়রা সহ বিভিন্ন প্রকার পাখি আতশবাজির প্রচন্ড শব্দে দিশেহারা হয়ে এদিক সেদিক ছুটে বেরিয়েছে নববর্ষে আতশবাজীর আলোকে আলোকিত এই মহানগরে।
আমাদের ছোটবেলায় ইংরেজি নববর্ষের উৎসব আমরাও করেছি। কিন্তু বর্তমানের আতশবাজি ফানুস উড়ারো ও পটকা ফাটিয়ে থার্টি ফাস্ট নাইট আমরা কখনই পালন করিনি। এটা আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে যায় না। আর তা পালন করিনি বলে আমরা আনন্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হইনি। নতুন বছরের প্রথমদিনে আমরা পরস্পরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। পরিবারের মধ্যে নানান খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে সামর্থ অনুসারে।
উৎসব, আনন্দ অন্যকে যেন কষ্ট না দেয়, অন্যের মাঝে যেন বিরক্তির সৃষ্টি না করে সে বিষয়টিকে সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এই ঢাকা শহরে শুধু মানুষ থাকে না। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পাখি, কুকুর, বিড়াল, বেজি, বানর ইত্যাদি। ঢাকা শহরের তথাকথিত নগরায়ন এর পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। কাচ আর স্টিলের অবকাঠামোয় সূউচ্চ অট্টালিকাসমূহ শহরকে পরিণত করছে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে। শহরের তাপমাত্রা কমছে না। প্রতিদিন কাচ আর স্টিলের বহুতল ভবন সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে ছড়িয়ে দিচ্ছে আরও বেশি তাপ। ভবনগুলোর ভিতরে চলছে সারাদিনব্যাপী সেন্ট্রাল এয়ালকুলার। বাড়ছে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ। ঢাকা পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরে। এর মধ্যে বিগত ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টায় নববর্ষ পালনে আতশবাজি আর ফানুস উড়ানো উৎসব শহরের প্রায় ১০টি স্থানে অগ্নিকান্ডসহ ঢাকার বাতাসকে করেছে আরো দূষিত।
আমাদের দেশে বহু পরিবেশবাদী সংগঠন রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে তাদের চিন্তার, উৎকণ্ঠার কোনো শেষ নেই। অথচ বিগত কয়েক বছরব্যাপী ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে প্রায় সারা রাতব্যাপী ঢাকা শহরজুড়ে আতশবাজী, বোমাবাজী ও ফানুস উড়ানোর যে মহোৎসব চলে সে ব্যাপারে তারা নির্লিপ্ত রয়েছেন। শহরের রাস্তার কুকুরপ্রেমী মানুষগুলোও ভাবেন না পাখিদের কথা, মা’র কোলে আতশবাজীর শব্দে কেঁপে উঠা শিশুটির কথা অথবা হার্টের রোগী প্রবীণ মানুষদের কথা। যারা বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকারের প্রশ্নে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন তারাও এবিষয়ে নিরব থাকেন বছরের পর বছর।
ভোগবাদী উৎসবের উপকরণ এসব আতশবাজী, পটকা- বোমা ও ফানুস শুধুমাত্র আজ রাজধানী ঢাকাই নয়, ছড়িয়ে গেছে গ্রাম-গঞ্জের ছোট ছোট টং দোকানেও। চীন থেকে আমদানী হওয়া এসব ক্ষতিকর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১০ টাকায়। ছোট শিশুরাও এগুলো নিজেরা কিনে প্রচন্ড শব্দে ফাটাচ্ছে। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় কোন দুর্ঘটনা। অথচ অনেক অভিভাবকই এসব কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। ঘৃণা আসে তাদের প্রতি যারা ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে জানান, “আমাদের উৎসবগুলো ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।” কারণ ঢাকা শহরের কতিপয় স্থান পুলিশ বিধিনিষেধ আরোপ করে যাতায়াত বন্ধ করেছে। এতে তারা খুবই দুঃখ পেয়েছেন। অথচ পরিবেশ দূষণের বিষয়, বিজাতীয় সংস্কৃতি তাদের মন ভরিয়ে দেয়।
কিন্তু দুঃখ এখানেই যে আতশবাজী, বোমাবাজী ফানুস উড়ানোর যে মহোৎসব চলে তা বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেন না। যে উৎসব আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না, বাঙালি চেতনার সঙ্গে যায় না, ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না, সে উৎসব যদি আজ ছিনতাইও হয়, তবে তা দোষের কি?
এখনও হয়তো সময় আছে ঘরের ছেলেদের ঘরে ফেরার। সংযমী আচরণ করার । সেই সাথে এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে। সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সামনে পবিত্র শবে-বরাত আসছে। শবে-বরাতের পবিত্র রাতেও এক শ্রেণীর মানুষ আতশবাজী, বোমাবাজীর মহোৎসব করে। এ বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপরতা আরো জোরদার করতে হবে। এতে পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে, মানুষের মনেও প্রশান্তি আসবে। আমাদের সবাইকে এখনই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্লিপ্তভাবে ঘরে বসে থাকার সময় আর নেই।