ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ইউক্রেনের অবস্থান ইউরোপে বর্তমান রাশিয়ান ফেডারেশনের পরেই। রাশিয়ার পরে এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইউক্রেনের পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পশ্চিমে রোমানিয়া ও মলদোভা, দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর ও আজভ সাগর, পূর্বে ও উত্তর-পূর্বে রাশিয়া এবং উত্তরে বেলারুস। ইউক্রেনের আয়তন ৬,০৩,৭০০ বর্গ কিমি, লোক সংখ্যা ৪ কোটি ৪৯ লক্ষ।। নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়লে যে পনেরোটি নতুন প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা পেয়েছে তার মধ্যে ইউক্রেন অন্যতম। অন্যান্য প্রজাতন্ত্রগুলো হচ্ছে জর্জিয়া, বেলরুশ, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখাস্তান, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং এস্তোনিয়ো।
ইউক্রেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট। একই বছরের ১ ডিসেম্বর গণভোটের মাধ্যমে জনগণ স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন দেয়।
ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তিকালে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার না ছিল যুক্তরাজ্যের কাছে, না ফ্রান্স, না চীনের কাছে। এটি ছিল ইউক্রেনের ভূমিতে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র ইউক্রেন প্রায় পাঁচ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র পায়, যা মস্কো সেখানে জমা রেখেছিল। ওই সময় কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে এর চেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্র ছিল।
সেই অস্ত্রগুলো ধ্বংস করে দেওয়াকে অনেক সময় নিরস্ত্রীকরণের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে, সেসময় ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের বিশেজ্ঞরাই পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অনেকের মতে, বিধ্বংসী ওই অস্ত্রগুলোই রুশ আগ্রাসন ঠেকানোর একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায় ছিল।
ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি জাহোরোদনিউকের ভাষায়, ‘আমরা বিনা কারণে পরমাণু অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছি’। এর বিনিময়ে পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া নিরাপত্তা গ্যারান্টি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন যখনই কেউ আমাদের কোনো কাগজে সই করতে বলে, তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া হয়, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক আগে আমরা এমন একটা কাজ করেছিলাম’।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে ইউক্রেনের মধ্যে ফের পারমাণবিক অস্ত্রধর হবার প্রবণতা রয়েছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইউক্রেন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মারিয়ানা বুডজেরিন বলেন, ‘মূল কথা হলো, আমাদের কাছে অস্ত্র ছিল, সেগুলো ছেড়ে দিয়েছি এবং দেখুন, এখন কী হচ্ছে’। তিনি বলেন,‘ নীতিগত পর্যায়ে হয়তো ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য কোনো নড়চড় দেখছি না। তবে জনতার পর্যায়ে এটাই বাস্তব’। ড. বুডজেরিনের মতে, ‘অনুশোচনা এর একটি অংশ মাত্র। আরেকটি অংশ হলো, অন্যায়ের শিকার হলেই কারও মনে যে ভাবনা চলে আসে’।
স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেন সর্বপ্রথম তার ভূখণ্ড থেকে সোভিয়েত অস্ত্রগুলো সরাতে উদ্যত হয়। বোমা, আর্টিলারি শেল, ল্যান্ড মাইন ও স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো স্থানান্তর যেমন সহজ ছিল, তেমনি সেগুলো শত্রুভাবাপন্ন কারও হাতে পড়ারও ঝুঁকি ছিল। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরানো ছিল কিছুটা কঠিন। কারণ এগুলোর কোনো কোনোটির ওজন ছিল ১০০ টন ও লম্বায় প্রায় ৯০ ফুট।
১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাসখানেক পরে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক কমান্ডার ও অধঃস্তন সেনাদের নতুন দেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের নির্দেশ দেন। এই পদক্ষেপে অবশিষ্ট অস্ত্রের ওপর সরকার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। তবে অনেকেই সেই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন এবং এতে ইউক্রেনের পারমাণবিক অস্ত্রাগারের ভাগ্য ও এর অপারেশনাল অবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তি ও ঝুঁকি তৈরি হয়।
সেসময় সাবেক পারমাণবিক-ঘাঁটি কমান্ডার ও পরবর্তীতে ইউক্রেনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ভলোদিমির টোলুবকো যুক্তি দিয়েছিলেন,‘ কিয়েভের কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না’। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে তিনি এক সমাবেশে বলেছিলেন, ইউক্রেনের নিজেকে ‘পরমাণু অস্ত্রমুক্ত’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত অপরিপক্ব এবং তাদের অন্তত কিছু দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ধরে রাখা উচিত ছিল। তবে ওই সময় তার এই প্রস্তাব খুব একটা জনসমর্থন পায়নি।
১৯৯৩ সালে শিকাগো ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ববিদ জন জে. মেয়ারশেইমার পারমাণবিক অস্ত্র ইস্যুতে মতামত দেন। তার যুক্তি ছিল, ‘ইউক্রেন যদি শান্তি বজায় রাখতে চায়, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্র অবশ্যক’।
বিতর্কের মুখে ১৯৯৩ সালে কিয়েভ সরকার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমারু বিমানের অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা শুরু করে। কিন্তু সেটি কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। পরিবর্তে দেশটি সিদ্ধান্ত নেয়, পরমাণু অস্ত্রের বদলে তাদের কঠিন নিরাপত্তা গ্যারান্টি দরকার। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি করে ইউক্রেন। তবে এ বিষয়ে কোন গণভোট হয়নি তখন।
বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম নামে পরিচিত ওই চুক্তিতে সাক্ষর করেছিল রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কোনো দেশই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করবে না এবং সবাই দেশটির সার্বভৌমত্ব ও সীমান্তকে সম্মান জানাবে। চুক্তিতে আরও বলা ছিল, আগ্রাসন হলে ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য চুক্তিকারীরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে।
ইউক্রেন ১৯৯৬ সালের মে মাসে তাদের শেষ পরমাণু অস্ত্রটি রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। বুদাপেস্ট চুক্তির অন্যতম সমঝোতাকারী ও ইউক্রেনে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিভেন পিফারের মতে, ভ্লাদিমির পুতিনের মতো একজনের খল নায়কের উত্থানেই ওয়াশিংটন ও কিয়েভের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালে রুশ সেনাদের ক্রিমিয়া আক্রমণ এবং পূর্ব ইউক্রেনে একটি প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে পুতিন কার্যত বুদাপেস্ট চুক্তিকে অকার্যকর ও অর্থহীন প্রমাণ করেন।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ইউক্রেনের বর্তমান সংকট পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে এবং এর ফলে ইরান ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোকে নিজেদের পরমাণু অস্ত্রধর হতে সচেষ্ট করতে পারে। ওয়াশিংটনের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক ড্যারিল জি কিমবল বলেন, কূটনৈতিকভাবে সমাধান পাওয়া না গেলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলো অপারমাণবিক রাষ্ট্রগুলোকে হুমকি দিতে পারে, এই ধারণা আরও শক্তিশালী হচ্ছে এবং এতে নিরস্ত্রীকরণের উৎসাহ কমে যাবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইউক্রেন যখন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল, তখন প্রায় ২০০ বছর ধরে রাশিয়ার মালিকানায় থাকা ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে ইউক্রেনের মালিকানায় দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কূটচাল থেকে তিনি এই কাজ করেছিলেন। অবশ্য তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, কয়েক দশকের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং তখন ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সত্যিই ভেঙে গেল এবং ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর আর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকলো না, তখন থেকেই ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার কূটনৈতিক বিরোধের সূত্রপাত। সোভিয়েত ইউনয়ন থেকে বেরিয়ে ইউক্রেন স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ হওয়ার পর তার জনগণের মধ্যে দু’ধরনের শিবির গড়ে ওঠে। ইউক্রেন রাশিয়ার লাগোয়া এলাকা বলে সেখানে অনেক জাতিগত রুশ নাগরিকের বসবাস। সেই রুশ নাগরিকেরা সব সময় রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে। অন্যদিকে, বাকিরা ইউরোপসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে। পশ্চিমাপন্থীরা চেয়ে আসছে, ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত হোক। একই সঙ্গে তারা ন্যাটোভুক্ত হোক। এই ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের যুক্ত হতে চাওয়াতেই রাশিয়ার যত আপত্তি এবং তখনই এ বিরোধের শুরু।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। এতে ইউক্রেনের বেশির ভাগ মানুষ খুশি হয়েছিল। কারণ, এই চুক্তিগুলো হলে দেশ আরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পাবে। ইউক্রেনবাসী খুশি হলেও ইয়ানুকোভিচের এ উদ্যোগ পুতিনকে বিচলিত করে । কারণ সেই চুক্তিটি হয়ে গেলে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পথ সহজ হয়ে যাবে। আর ইউক্রেন ইইউর সদস্য হয়ে গেলে একসময় রাশিয়ার ঘোর শত্রু ন্যাটোরও সদস্য হয়ে যাবে।
এ চিন্তা থেকেই ইয়ানুকোভিচের ওপর পুতিন এমন চাপ দিলেন যে ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে সেই চুক্তির আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এত বড় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ইয়ানুকোভিচ নষ্ট করে দিলেন কেন?—এ প্রশ্ন রেখে ইউক্রেনবাসী বিক্ষোভ করলে ইয়ানুকোভিচের পতন হয় এবং তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর ইউক্রেনের ভেতরে যেসব এলাকায় জাতিগত রুশ লোকের বসত, সেখানে পুতিন ইউক্রেন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ উসকে দেন। বিদ্রোহীরা ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে। পুতিন এই বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে যে সেনাবাহিনী পাঠান, তারা ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে এবং পুতিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার নিজের ভূখণ্ড বলে ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে এ অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য ঠেকাতে ন্যাটো ধীরে ধীরে সেনা মোতায়েন বাড়াতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর একের পর এক ন্যাটোতে যোগ দিয়েছিল চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও আলবেনিয়া। এই দেশগুলো একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য ছিল। এদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইছে জর্জিয়া, মলদোভা ও ইউক্রেন। কিন্তু সেখানে রুশপন্থী সশস্ত্র মিলিশিয়াদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে এবং রাশিয়া তাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ওই মিলিশিয়াদের কারণে তারা ন্যাটোতে যোগ দিতে সংশয়ে আছে।
প্রশ্ন হচ্ছে ইউক্রেন ন্যাটোয় যোগ দিলে রাশিয়ার কী সমস্যা? মূল সমস্যা হলো, রাশিয়া দেশ হিসেবে বিশাল বড় হলেও সারা বছর সচল রাখা যায় উষ্ণ পানির এমন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর তাদের প্রায় নেই। কিন্তু ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌঘাঁটি গেড়েছে, সেখানে সে ধরনের উষ্ণ পানি আছে। আর রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরে ঢোকার একমাত্র পথও হলো এই বন্দর। এ কারণে ক্রিমিয়ার অবস্থানগত মূল্য অনেক। ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য হয়, তাহলে সেখানে ন্যাটো বাহিনীর আনাগোনা শুরু হবে। আর সেটি হলে কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার যাওয়া–আসা আগের মতো সহজ থাকবে না। কাজেই ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়া রাশিয়ার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এর আগে যতবার পোলিশ, সুইডিশ, ফরাসি, জার্মানসহ অন্যান্য বিদেশিদের আক্রমণের মুখে রাশিয়া পড়েছে, তার সবগুলোই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে। এ কারণে ওই অঞ্চলের দিকে রাশিয়াকে বাড়তি নজর দিতে হচ্ছে। আর এ কারণেই ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৮ হাজার ২৪৬ বর্গকিলোমিটারের বিশাল রাশিয়া মরিয়া হয়ে মাত্র ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের পুঁচকে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
সত্যিকার ভাবে রাশিয়ার নেতা প্রেসিডেন্ট পুতিন চান ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। তিনি পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এ নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন যে, ন্যাটো আর এ অঞ্চল থেকে নতুন করে কোনো দেশকে সদস্য করবে না। কিন্তু পশ্চিমারা তাতে রাজি হয়নি। পুতিন মনে করছেন, পশ্চিমারা ন্যাটোর বাহিনী দিয়ে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে। এ কারণে তিনিও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুতিনের অবস্থান সঠিক হলেও একটি স্বাধীন দেশে তিনি সরাসরি হামলা করতে পারেন না।
তবে পুতিনের সবচেয়ে বড় জোর হলো তার জ্বালানি রাজনীতি। ইউক্রেনের মধ্য দিয়েই পাইপলাইনে করে রাশিয়া থেকে গ্যাস যায়। ইউরোপে । এ গ্যাস সরবরাহ যদি রাশিয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউরোপের বহু বাড়িতে রান্নার চুলা পর্যন্ত জ্বলবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যে চারটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে, সেগুলো হলো রাশিয়া, নরওয়ে, আলজেরিয়া ও কাতার। এর মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে আসে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেক আছে। রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ কাঠ ও কয়লাও আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে।
লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়া রাশিয়ার জ্বালানির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এ পাইপলাইন দিয়ে।ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো যদি ‘বৈরী আচরণ’ করে, তাহলে রাশিয়া এসব সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। এতে গোটা ইউরোপ মহাদেশ বেকায়দায় পড়ে যাবে। এই বিষয়গুলো মাথায় নিয়েই পুতিন অগ্রসর হয়েছেন।
সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পরে রাশিয়া ভেবেছিলো পশ্চিম ইউরোপ তাকে সঙ্গে নিয়ে একসাথে পথ চলবে। ন্যাটোর কার্যকারিতা ফুরিযে যাবে এবং তা বিলুপ্ত হবে। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। বরং মার্কিন স্বার্থে পশ্চিম ইউরোপ ন্যাটোকে টিকিয়ে রেখেছে। শুধু টিকিয়েই রাখেনি পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য বানিয়েছে। অর্থাৎ একঅর্থে শীতল যুদ্ধ টিকিয়ে রাখতে ও নতুন মাত্রা দিতে চেয়েছে। অন্যদিকে আজকের পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা বর্তমানে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে পশ্চিম ইউরোপকে ব্যাপক ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। পরিপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইউরোপকেই অর্থনৈতিক সংকটে ফেলবে। সদ্য আফগানিস্তান ফেরত পরাজিত মার্কিন প্রশাসনও বড়কোন অভিযানে যাওয়ার সক্ষমতা এই মুহূর্তে রাখে না। কোভিড ১৯ পরবর্তী বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ তাতে ঘি ঢালবে বেশি মাত্রায়।
জাতিগত এবং ভাষাগত ভাবে বিভক্ত ইউক্রেন দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারবে না। রুশ ভাষাভাষি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কখনই সংখ্যাগুরু ইউক্রেনিয়ান ভাষাভাষিদের মেনে নেবে না। ইউক্রেনে ধর্মবিশ্বাসীদের অধিকাংশই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। প্রায় ৫ লাখের মতো ইসলাম ধর্মাবলম্বী রয়েছে। এর মধ্যে তিন লাখই তাতার। বর্তমানে ইউক্রেনে মুসলিমদের ৪৪৫টি কমিউনিটি আছে। এই কমিউনিটিগুলোতে সাধারণত নামাজের ঘর, কনফারেন্স হল, ইন্টারনেট ক্লাব, ক্রীড়া প্রশিক্ষণ হল, খেলার মাঠ ও ইসলামী বইয়ের বিশাল গ্রন্থাগার থাকে। তাদের উদ্যোগে সব বয়সী মুসলিমদের ইসলামী শিক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় নওমুসলিমদের ইসলামী দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
এরা কার পক্ষে যাবে তা এখনই বলা মুস্কিল। রাশিয়ার আগ্রাসন দীর্ঘায়িত হলে ইসলামী মৌলবাদ মাথাচারা দিতে পারে। অন্যদিকে ইউক্রেনের জিডিপির প্রায় ৬১ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র একশোজন ধনী ব্যক্তি তাই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এদেরকেও বিবেচনায় নিতে হবে।
মূলত রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন তিনটি কারণে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাচ্ছেন, প্রথমত, শীতল যুদ্ধের পর সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া চায় কৃষ্ণ সাগরে ঢোকার একমাত্র পথটি নিজের অধিকারে রাখতে। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের রাজনীতির ইউরোপপন্থীদের দমন করা। তৃতীয়ত, ক্রিমিয়ার সঙ্গে দনেস্তক ও লুহানস্কের সংযোগ ঘটানো যাতে রাশিয়া সমর্থিত একটিক ছায়ারাষ্ট্র জন্ম নিবে। চর্থুতত,রাশিয়ার গ্যাসের পয়সা, তেলের পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইউরোপের বড় সব রাজনীতিকদের পকেটে। আর তাই অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অবরোধে রাশিয়ার তেমন যায় আসে না। আজকের ইউক্রেন আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে ক্রেমলিন একদশকেরও বেশি সময় ধরে।
ভাষা ও জাতিগত বিভাজনের দেশ ইউক্রেনে সংহতি কিভাবে ধরে রাখবেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তা স্পষ্ট নয়। পেশাগত জীবনে একজন বিখ্যাত কৌতূক অভিনেতা তার অভিনিত চরিত্রের কারণে অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তায় রাষ্ট্রপতি নির্বচিত হয়েছেন। কিন্তু বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধাবস্থায় দেশের বিভাজিত জাতিকে নের্তৃত্ব দেওয়ার মতো প্রজ্ঞা এবং ধৈর্য্য কি তিনি দেখাতে পাবেন? হয়তোবা সময়ই তা বলে দেবে।