প্রথম পরিচ্ছেদ
দানবের কবলে
পিপ- পিরীপ তার ঘরোয়া নাম। কিন্তু ভুলেও সে নামে ডাকেনি কেউ। সকলেই যেন ভুলে গেছে; একবারটিও মনে করতো না পিপের পোষাকী নাম পিপও নয় পিরীপও নয়, তা ফিলিপ।
সমুদ্রের কাছাকাছি তাদের গ্রাম।
প্রায় বিশ মাইলের মধ্যে সরোষে গর্জাচ্ছে সফেন সমুদ্র। গাঁয়ের উপরেই নদী। নদী গিয়ে মিশেছে সমুদ্র মোহানায়।
পিপের নাম নিয়ে যে-জগাখিঁচুড়ি পাকিয়েছে, তার বাপমায়ের বেলাতেও তাই খাটে।
পিতামাতার নামে তার পরিচয় কেউ রাখতো না। তা-ও সবাই ভুলে গেছে, কিংবা সবাই সেদিকটায় থাকতো নীরবই।
গ্রামের সকলে বলতো, পিপ মিসেস জো গারগেরির ভাই।
জো গারগেরি গাঁয়ের ডাকসাঁইটে কামার। সকলের মধ্যে তার সুযশ মেলাই। নামডাকও প্রচুর। পিপের বোন তার স্ত্রী। সবাই মনে করতো, সবাই জানতো পিপ বরাবর কামার জো-ও সহকারী হিসেবে কাজকর্ম করবে, কাজকর্ম শিখবে।
পিপ বড়ো হবে, একদিন সেও তরুণ হবে, যুবক বয়সে গিয়ে পড়বে, আশ্চর্য, গাঁয়ের কেউই যেন তা ভাবেনি একবারটিও।
আর পিপ? পিপ নিজেও কিন্তু এদিক দিয়ে ছিল পুরোদন্তুর বেপরোয়া। ভালোমন্দ কিচ্ছু সে ভাবতো না, ভাবতে পারতোও না।
পিপের বাপ ফিলিপ মা জজিআনা পিরীপ। তাঁরা দু’জনই গতায়ু। অনাথ পিপ বোনের ভালোবাসা পেয়েছে। তা কি কম? সে যে ভগিনীপতি কামার জোর-ও প্রীতি পেয়েছে, তা-ই যথেষ্ট নয় কি?
পিপ অন্তত তাই ভাবতো।
বোন আর ভগিনীপতির ভালোবাসা পেয়েই পিপ ছিল খুশি, নিশ্চিন্ত।
.,.. ....
তবে এক ব্যাপারে তার ছিল ভয়ানক দুর্বলতা।
জন্মাবধি মা-বাবা হারা সে। তাদের কাউকে সে দেখেনি চোখের দেখাও। তাদের কাউকে সে দেখেনি চোখের দেখাও। তবু গাঁয়ের সুদূর শেষপ্রান্তে কবরস্থানে গিয়ে মা-বাবার কবরের কাছে বসতে, বেড়াতে তার খুবই ভালো লাগতো।
একমাত্র এই ব্যাপারটাই তাকে নেশার মতো পেয়েছিলো।
গ্রাম্য ফুলভর্তি ছোট্ট দুটো হাত ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখতো সে পুরাতন কবরের গায়। তারপর নির্বাক-নিশ্চুপ কণ্ঠে বসে থাকতো কিছুক্ষণ।
কি ভাবতো, কি বলতো মনে মনে সে, কেউ জানে না তা।
-- ---------------------------------------------------
বহুদিনের অভ্যাসমত সে-দিনও গেছে পিপ। গ্রাম থেকে কবরস্থান অনেকটা দূরের পথ। তাছাড়া পথটা বেশ নির্জনও বটে। আশেপাশে লোকজনের বসতি নেই বললেই চলে। কিন্তু পিপের নজর নেই কোন দিকেই। সে হনহন্ করে ছুটে যেতো। তার গন্তব্য পথ ভিন্ন আর কোনদিকে থাকতো না তার চোখ। ভয়ও নেই, ভাবনাও নেই। নির্বিচারে নির্বিকল্প সে পথে সে বরাবর গেছে- এসেছে।
তখন ডিসেম্বর মাস। বড়দিনের আগের দিন পিপ রওনা হয়ে গেছে কবরস্থানের দিকে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে এরই মধ্যে। সামনে পিছনে ঝোঁপে-ঝাড়ে কমবেশি অন্ধকার। শনশন্ হাওয়া বইছে।
পিপের হাত ভর্তি বুনো ফুল। সেগুলো সে নামিয়ে রাখলো কবরের গায়। মাথা নত করে প্রার্থনায় বসলো। না দেখা মা-বাবার কথা সে মনে মনে ভাবলো। বিষন্ন মুখ-চোখ তার।
অকস্মাৎ কী একটা শব্দ শুনে সে চমকে উঠলো।
এতোকাল এখানটায় আসছে যাচ্ছে সে, কিন্তু কই, কোন মানুষের সারাশব্দ সে তো পায়নি।
তবে কিসের শব্দ?
মাথা ফিরিয়ে কিছু দেখতে যাওয়ার আগে একটা শক্ত হাতের কঠিন আঘাতে সে বিদ্যুৎ বেগে ফিরে চাইলো।
উঃ! কী ভীষণ ভয়াবহ দানবের কবলে পড়েছে সে? ভীতিপ্রদ লোকটার চেহারা। ভাঙা খনখন গলার আওয়াজ।
ডান হাতে ছুরি।
লোকটার বাঁ হাতের মধ্যে ছোট্ট পিপ বাঁদর ঝোলা ঝুলছে। তখন! ভয়ে ত্রাসে তার প্রাণ যায় আর কি!
সে কাতর গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ দোহাই আপনার। আমার গলা কাটবেন না। আমি কিছু করিনি!’
দানবের মতো লোকটা সরোষে গর্জে উঠলো,
কি নাম তোর? বল্ শীগগির বল্ আমাদের কাছে!
আমাদের কাছে? তার মানে এমন দস্যুর মতো লোকটার সঙ্গে আরও লোক আছে তা হলে? ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসে পিপের।
কোনক্রমে বললো সে, স্যার, পিপ আমার নাম।
লোকটার বাঁ হাতের মুঠি থেকে এতোক্ষণে ছাড়া পেলো পিপ। তার ছোট্ট মুখের উপর আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে লোকটার দুটো বড়ো বড়ো চোখ।
হাঃ! হাঃ! হাঃ! ভালুকের বাচ্চা, টসটসে গোস্ত দেখছি তোর! এখুনি খেয়ে ফেলতে মন চায়। কিন্তু কি করি, কি করি!
হাত জোড় করে বললো পিপ,
মাফ করুন। আমাকে মাফ করুন। দোহাই আপনার আমাকে সত্যি সত্যি খাবেন না। আমাকে ছেড়ে দিন।
‘ছেড়ে দেবো? হাঃ! হাঃ! হাঃ! লোকটা আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, যদি ছেড়ে দেই তোকে, বাঁচতে সুযোগ দেই, তাহলে বলতো কে কে আছে তোর? কোথায় থাকিস তুই?
আর্তকণ্ঠে পিপ বললো,
‘আমার বোনের বাড়িতেই থাকি আমি। মিসেস জো, মানে মিসেস গারগেরি। আমার বোনেরই জামাই গ্রামের কামার।
আর কিছু শুনলো না লোকটা। পিপের শেষের কথা শোনা মাত্রই সে লাফিয়ে উঠলো।
কি বললি? কামার? তোর ভগ্নিপতি লোকটাই তা-হলে গাঁয়ের কামার?
পিপ আর কি জবাব দেবে? সে তখন ভয়ে ঠকঠক্ করে কাঁপছে-কাঁপছেই।
দানবটা বললো, ‘এখন ভেবে দেখতে হবে তুই মরবি, না তোকে ছেড়ে দেবো। তার আগে সাফ জবাব দিবি, লোহা কাটার করাত কাকে বলে জানিস্ তুই? হাতুড়ি চিনিস হাতুড়ি?
‘চি-চিনি, আ- আমি চিনি।’
ভয়ে আশংকায় তার তখন মারা যাবার অবস্থা। পিপের গলায় আর যেন জোর নেই।
(চলবে)