সাম্প্রতিক প্রকাশনা

দুই নগরের উপাখ্যান ( ষষ্ঠ পর্ব)

আলতামাস পাশা লেখাটি পড়েছেন 1193 জন পাঠক।
 “ A good leader takes a little more than his share of the blame, 
a little less than his share of the credit”
- Amold Glasow

ষষ্ঠ পর্ব

মৃন্ময়ী চাকমার সঙ্গে লিন্ডার প্রথম পরিচয় হয় রায়হানের মাধ্যমে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই ’৭২ সালে মৃন্ময়ীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার তার দেখা হয়। বড্ডো বিরক্ত আর বিক্ষুব্ধ ছিল তখন মৃন্ময়ী। মৃন্ময়ীর কথা মনে হতেই লিন্ডার স্মৃতিতে অনেক কথা এসে ভিড় করে।.....

রায়হানের একটি অপারেশন ছিল মাটিরাঙা জেলায়। ষোল জনের একটি গেরিলা দলকে দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে রায়হান এ অপারেশনে অংশ নেয়। জুলাই মাস ’৭১ সাল। বর্ষার প্রবল বর্ষণে বাংলাদেশ ভিজে চলেছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটা শক্ত ঘাঁটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিরাঙ্গায়। মাটিরাঙ্গার ঘাঁটিটি দখল করতে পারলে খাগড়াছড়িতে প্রবেশ করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বেশ সহজ হয়ে যাবে। তাই এই অপারেশনের গুরুত্ব ছিল রায়হানের কাছে অপরিসীম। 

মাটিরাঙার পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পটিকে ক্যাম্প বললেই যথার্থ বর্ণনা দেয়া হয় না, পাকিস্তান বাহিনীর এ আস্তানাটি ছিলো রীতিমতো একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের সড়ক বিপদমুক্ত রাখতে আর মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যেকোন সময় চিরুনী অভিযান চালাতে এ ঘাঁটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পুরো দু’ কোম্পানী পাকবাহিনী ছিল এ ক্যাম্পে। এই ঘাঁটি দখলে আসলে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবান প্রবেশ করা সহজ হতো। তাই এই অপরাশেনের দায়িত্ব রায়হানের ওপর পরে। 

তবে রায়হান এ অপারেশনে একটি হঠকারী কাজ করেছিল। এতো বড় ও শক্তিশালী ঘাঁটি ধ্বংস ও দখলের পরিকল্পনা তৈরী করা হয় মাত্র দু’টো মেশিনগান, একটি এলএমজি, চারটি এসএমজি, আটটি .৩০০ রাইফেল আর একটি মর্টার নিয়ে। মূলত এই গেরিলা গ্রæপটি ছিল একটা ‘সুইসাইডাল স্কোয়াড’। আর তাই, পুরো ঘাঁটি ধ্বংস করা না গেলেও ১০ জন পাক সৈন্য মারা যায়, আহত হয় প্রচুর। হামলায় রায়হানের গ্রুপের ১৬  জনের গেরিলার ১১ জনই ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাদকবাকীরা রায়হানকে গুরুতর আহত অবস্থায় কোন রকমে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের গ্রামে।

পাহারের উচুঁ-নীচু বুক চিরে গড়া আদিবাসী গ্রামগুলোতে এক সময় সন্ধ্যা নামে। মাটি থেকে প্রায় ৬ ফুট উচুঁ বাঁশের মাচানের ওপর তৈরি ঘর। এসব ঘরে উঠবার জন্যে একখানা সাধারণ খাঁজকাটা গাছের ডাল লাগান রয়েছে আড়াআড়ি ভাবে। কুঁড়ে ঘরের মাচানের নীচে ফাঁকা জায়গায় মুরগি, ছাগল, শূকর রয়েছে চড়ে বেড়াচ্ছিল। মাচাং এর কাছাকাছি কয়েকজন পাহাড়ি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। রায়হানকে বহনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি আসতে দেখে তারা কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময় মেশানো চোখে তাকিয়ে থাকে। এ সময় কোন আদিবাসী পুরুষ গ্রামটিতে চোখে পড়ে না। তাই রায়হানের সহযোদ্ধারা একটু যেন ভরসা পায়। কারণ  মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুরং আদিবাসীরা তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করে। অন্যদিকে রাজা ত্রিদিব রায়ের কারণে চাকমারাও পাকিস্তানীদের পক্ষে তখন। একমাত্র মগ আদিবাসীরাই তাদের রাজা মং প্রুসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। 

নানিয়ারচরের যুদ্ধ তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে তীব্র ক্ষত হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল মিজো আদিবাসীরা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই মিজোরা হল ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো উপজাতিদের কিছু সংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী, যাদের পাকিস্তান সরকার দীর্ঘদিন আশ্রয় দেয় এবং প্রশিক্ষণ দেয় ভারতের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালানোর জন্য।

ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিলেন। মিজোদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো এবং আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে লাগলো এবং অব্যাহত আক্রমণের মুখে খালেকুজ্জামানকে সাহায্যের জন্য লেঃ মাহফুজ দু’টো কোম্পানী নিয়ে তড়িৎ গতিতে মিজোদের ওপর আঘাত হানতে লাগলেন। হাজার হাজার মিজোর তীব্র আক্রমণে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটে আসতে বাধ্য হলেন । লেঃ মাহফুজকে সশস্ত্র মিজোরা একসময় ঘিরে ফেললো শোচনীয় অবস্থায় লেঃ মাহ্ফুজ মেজর শওকতকে সাহায্য পাঠাবার জন্যে অনুরোধ করলেন। সশস্ত্র মিজোদের আক্রমণের তীব্রতা বুঝতে পেরে মেজর শওকতের নির্দেশে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান লেঃ মাহফুজের সাহায্যে অগ্রসর হলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সতর্কতাকে অগ্রাহ্য করে সহস্রাধিক মিজো এবং ১২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টেন দুটো কোম্পানী মর্টার, মেশিনগান ইত্যাদির সাহায্য আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যূহ ভেদ করে তীব্র গতিতে সামনে অগ্রসর হবার চেষ্টা করতে থাকে। এই তুমুল যুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা ক্যাপ্টেন আফতাব শহীদ হলেন। বৃষ্টির মত গুলির মধ্যে শওকত, ফারুক এবং সিপাই ড্রাইভার আব্বাস ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের মৃতদেহ গাড়িতে করে রামগড়ে নিয়ে আসেন। এই মৃত্যু মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল কিছুটা হলেও ভেঙ্গে দেয়। 

চাকমারা যদিও সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যায়নি, তবুও সবার মনই ভয় ও কিছুটা সন্দেহে দোদুল্যমান থাকে। আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে থেকে একটি মেয়ে এগিয়ে আসে। মারাত্মক আহত রায়হানের শরীরে দিকে তাকিয়ে যা বোঝার মেয়েটি বুঝে যায়। মেয়েটির সহানুভূতি মাখা চোখের দিকে তাকিয়ে রায়হানের সহযোদ্ধা মারুফ বুঝে যায় আপাতত কোন ভয় নেই। বরং সাহায্য পাওয়া যাবে। খাবার পাওয়া যাবে। আশ্রয় পাওয়া যাবে। অবশ্য সমস্যা হচ্ছে গ্রামের পুরুগুলো ফিরে আসলে পরিস্থিতি না আবার অন্যরকম হয়ে যায়। তবুও দেখা যাক একটি রাতের মতো আশ্রয় মেলে কিনা। ভীষণভাবে আহত রায়হানকে গ্রামের মাচাংগুলোর সামনে খোলা জায়গায় নামিয়ে রাখে মারুফ ও তার সহযোদ্ধারা। ততক্ষণে আকাশে একটি দুটি করে তারা উঠতে শুরু করেছে। দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী মেয়েদের একজন দৌঁড়ে গিয়ে মাচাং এর সিঁড়ি বেয়ে একটি বাতি নিয়ে আসে। 

রায়হানের ক্ষতস্থানের মারুফ যে কাপড় বেঁধে দিয়েছিল তা এখন রক্তে একেবারে ভিজে গেছে। প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে রায়হানের। জ্ঞান আছে কিনা সন্দেহ। রায়হান বাঁচবে তো? মারুফরা চিন্তিত হয়ে উঠে। আদিবাসী মেয়েটি এ সময় একটি কলসিতে পানি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। মারুফদের কিছু না বলে ধীরে ধীরে সে মাটিতে শোয়ানো রায়হানের পাশে বসে। আস্তে, খুব সাবধানে রায়হানের ক্ষত স্থানের রক্ত ভেজা কাপড়টি খোলে। ছুরি দিয়ে রায়হানের পরনের সার্টের খানিকটা জায়গা কেটে দেয়। তারপর একটি আলাদা পাত্রে কলসি থেকে পানি নিয়ে তার সঙ্গে পাহাড়ি গাছগাছড়ার শিকলমূলের রস মিশায়। ন্যাকরা ভিজিয়ে রায়হানের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা আরম্ভ করে মেয়েটি। মারুফরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অজানা পাহাড়ী এলাকায় এক আদিবাসী মেয়ের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হতে থাকে।

এই আদিবাসী মেয়েটির নাম মৃন্মমী চাকমা। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল তার গ্রামের সবার ওপর জেদ করে। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে থাকতেই মুক্তিয্দ্ধু শুরু হয়ে গেল। ২৫ মার্চ রাতে যে ক‘জন মেয়ে রোকেয়া হল থেকে পালাতে পেরেছিল মৃন্ময়ী ছিল তাদেরই একজন। ছাত্র ইউনিয়নের তুখোর কর্মী হিসেবে মার্চ মাসেই ঢাকায় ট্রেনিং নিচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য রমনার মাঠে।

২৫ শে মার্চের সেই রাতের কথা ভাবলে এখনও মৃন্ময়ী ঘুমের মধ্যে শিউরে শিউরে ওঠে। মনে হয় অনেক কথা- অনেক স্মৃতি......

২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল। ৪০০ ছাত্রীকে পাকিস্তানী বাহিনী সেই কালো রাতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। কত বয়স সেসব ছ্ত্রাীদের? উনিশ. কুড়ি, একুশ, বাইশ। সেই ছ্ত্রাীরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল। ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব তারা লড়েও ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। অবশিষ্ট ৪০০ ছ্ত্রাীকে নিয়ে চললো জানোয়ারদের নৃশংস নারকীয় উল্লাস। ঐ ছ্ত্রাীদের তারা ধর্ষণ করলো ২৫ মার্চ রাতে, তারপর দিন, তারও পরের দিন। অনেকে অবশ্য ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে পড়ে আতœহত্যা করে। কিন্তু বেঁচে থেকে যাঁরা ধরা পড়েছিল তাদের নিয়ে পাকিস্তানীরা যা করলো তা’কি তারা নিজেদের মা -বোন বা মেয়ের সঙ্গে কোনদিনও করতে পারতো? হয়তোবা পারতো, কারণ বেলুচিস্থানেও তারা এমনটিই করেছিল।

গোটা বাঙালি জাতি আর বাংলাদেশের ইজ্জত নষ্ট করতে এসব বাঙালি মেয়েকে তারা নগ্ন করে দিল। হিংস্র বলাৎকার শেষে বেশীরভাগ মেয়ের স্তন কেটে ফেললো। গোপন অঙ্গে বেয়নেট ধুকিয়ে দিল। যেসব মেয়ে খুব সুন্দরী ছিল তাদের কপালে জুটলো আরও পৈশাচিকতা। এসব যুবতীর পায়ু পথে জঘন্য ক্রোধে পাকিস্তানীরা তাদের রুলার এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করালো।

বার বছরের রাবেয়া তার বোনের কাছে বেড়াতে এসেছিল। ধর্ষণ বা নর-নারীর মিলনের ব্যাপারে যে মেয়ে কিছুই বুঝতো না তাকে শত শত পাঞ্জাবী ভাইয়ের সামনে পুরো নেংটা করে দেয়া হল। পাঞ্জাবী মেজর জানজুয়া তার নির্দয় হাতে রাবেয়ার কিশোরী স্তন দলিত-মহিত করতে করতে বলে, ‘মেরী জান, আভি হাম তোমকো সাচ্চা পাকিস্তানী বানাতা হ্যাঁয়’। মেজর জানজুয়া যখন বাংলাদেশের কিশোরী মাটি নির্দয়ভাবে কর্ষণ করছিল তখন রাবেয়ার আতœা বাংলাদেশের আলো- বাতাস মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

কিন্তু, কোথায় রাবেয়াদের কথা তো কেউ মনে রাখেনি। এদের আত্মদানের কথা মনে রেখে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে? ’৭১ এর মৃন্ময়ী চাকমা জানতো রাবেয়াদের আতœত্যাগ বৃথা যাবে না। কিন্তু আজ মৃন্ময়ী জানে রাবেয়াদের আতœত্যাগ মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। আর তাই বলা হয় সে সময় রোকেয়া হলে কোন মেয়ে ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক মি: এ, স্যানডারস-Blitz পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই রোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর তথ্য-ছাপান। তিনি আরও লিখেছিলেন, পাঞ্জাবী মেজর জানজুয়া বলেছেন,‘Kill Bangalees, rape their women, burn their houses and loot their valuables........

আদিবাসিদের সেবার গুণে, পাহাড়ী গাছ-গাছড়ার ভেষজ ক্রিয়ায় আর নিজের প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তির জোরে রায়হান দীর্ঘ চারমাস পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলো। কিন্তু বেচারা তার ডান পা টি চিরকালের জন্যে হারালো। পায়ের ক্ষত থেকে বুলেট বের করা যায়নি বলে তাতে পচন ধরে গ্যাংগ্রীনের উপক্রম হচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়েই মারুফ, মৃম্ময়ী সবাই মিলে যন্ত্রণায় অচেতন রায়হানের অঙ্গহানী ঘটায়।

পা হারাবার কারণে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া বন্ধ হলো রায়হানের। কিন্তু যুদ্ধের কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে তাকে বাদ দেয়া যায়নি। 

সময় দ্রুত গড়িয়ে চলে। অপারেশন জ্যাকপট নাম দিয়ে চট্টগ্রাম ও মঙ্গলার সামুদ্রিক বন্দর, চাঁদপুুর, দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, নগরবাড়ী, খুলনা, বরিশাল, গোয়ালন্দ, ফুলছড়িঘাট ও আড়িচা ঘাটের নদীবন্দরগুলোর ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ সেনাদের আ্ক্রমণ তখন জোরদার হচ্ছে।

মে মাস থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করে রায়হানের গ্রুপটি। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্যে পাক-বাহিনী কি ধরণের রক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সৈন্যরা কোথায় ও কিভাবে পাহারার ব্যবস্থা নিয়েছে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পরে খবর চলে গেল সংশিষ্ট সেক্টর কমান্ডারের কাছে। অপারেশনের দিন ধার্য হল ১০ আগস্ট, ১৯৭১।

চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বাছাই করা ৬০ জন তরুণকে তিনভাগে ভাগ করা হল। ১ এবং ২ নম্বর দল স্থলপথে মিরেশ্বরাই, সীতাকুন্ড এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলীর পূর্বপাড় চরলাক্ষার সর্বশেষ ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছোবে বলে ঠিক করা হয়। ৩ নম্বর গ্রুপ চরলাক্ষায় যাবে নৌকা করে। ৩ নম্বর গ্রুপের কাছেই লিমপেট মাইন,এক জোড়া র্ফিন এবং শুকনো খাবার দেয়া হয়। গ্রুপ কমান্ডারকে আরও দেয়া হয় হালকা অথচ শক্তিশালী একটি ট্রানজিস্টার সেট। তাকে এ মর্মে নির্দেশনা দেয়া হয় যে,আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের প্রতিটি সঙ্গীতানুষ্ঠান খুব মন দিয়ে তাকে শুনতে হবে। আসলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী থেকে সাজানো হয়। 

৯ আগস্ট, ১৯৭১ সাল। হরিণা ক্যাম্পে রায়হানদের চূড়ান্ত নির্দেশ এসে পৌঁছোয়। পথপ্রদর্শক এবং কুলিসহ সবাইকে বলে দেয়া হয় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কখন কিভাবে অগ্রসর হতে হবে, পথে কোথায় কোথায় থামতে হবে ইত্যাদি ব্যাপারগুলো। ১৩ আগস্ট ১ ও ২ নম্বর গ্রুপ চরলাক্ষার পূর্ববর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়। জায়গাটি ছিল চট্টগ্রাম শহরের কাছেই। পথের অবশিষ্ট অংশটুকু এদের জন্য খুবই মারাতœক ছিল, কারণ তাদেরকে শহরের ভেতর দিয়ে গিয়ে তারপর নৌকায় নদী পার হতে হবে। এরপরই তাদের শেষ ঘাঁটি চরলাক্ষা। এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে দখলদার বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনী তীব্র আক্রমণ চালাবে। এ কারণে শক্ররা ছিল পুরো সতর্ক অবস্থায়। সারারাত ধরে ছিল কারফিউ। কিন্তু সব চেকপোস্ট ও বাঁধা পার হয়ে চরলাক্ষায় মুক্তিযোদ্ধারা পৌঁছায় একটি অ্যাম্বুলেন্স ও বিদ্যুৎ বিভাগের পিকআপ ভ্যানে। তারপর পাক-সেনাদের নাকের ডগা দিয়ে গেঁয়ো কাপড় পরা একদল লোক ফলমূল, মাছ, চাল এবং লবণের ঝুড়ি নিয়ে ফেরী নৌকায় উঠলো এবং নৌকার মাঝি যখন নিশ্চিত মনে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে কর্ণফুলীতে পারি জমালো তখনও পাকিস্তানীরা কিছু বুঝতে পারে নি। তারা ভেবেছে লোকগুলো বাজার সেরে বাড়ি ফিরছে।

১৩ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে সংগীতানুণ্ঠানে পুরনো দিনের একটি বাংলা গান, “আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি” বেজে উঠলো। প্রথম সংকেত পেল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। কমান্ডার জানতেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে আরেকটি গান তিনি শুনতে পাবেন। আর তক্ষুনি আরম্ভ হবে, “ অপারেশন জ্যাকপটের” চূড়ান্ত পর্যায়।

১৪ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে শোনা গেল একটি পূজা পর্যায়ের রবীন্দ্রসংগীত, “আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাইনি কোন দান”...। অর্থাৎ ঐ রাতেই নৌ কমান্ডোদের আঘাত হানতে হবে পাকিস্তানী জাহাজগুলোতে।

১৫ আগস্ট দিবাগত রাত ১টা। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম পুরো ঘুমিয়ে। শান্ত নদীতে স্রোতের কুলু কুলু ধ্বনি। দূরে বঙ্গোপসাগরের অসীম জলরাশি। নিঃশব্দে বাংলাদেশের নৌ কমান্ডোরা নদীর পারের দিকে এগিয়ে যায়। অপর পাড়ের জেটিগুলো তখন ইলেকট্রিক আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। সার্চ লাইট ফেলে নদীর ওপর লক্ষ্য  রাখছে সৈন্যরা। 

১৪ আগস্ট এবং তার পূর্ববর্তী কয়েকদিন পাকিস্তানীদের ওপর দিয়ে বেশ বড় রকমের ধকল গেছে । তাই এ রাতে তাদের সকলেই যেন একটু বেশি নিশ্চিন্ত। পাকা প্ল্যাটফর্মের ওপর ভারী ও লম্বা ক্রেণের ছায়াগুলোকে কেমন ভৌতিক বলে মনে হয়। 

নদীর দিক থেকে পাকসেনাদের কোন ভয়ের আশঙ্কা নেই। কোন নৌকা বা সাম্পান জাহাজের দিকে আসতে গেলে তা পরিষ্কার দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে দূর পাল্লার কামানই যথেষ্ট। 

জেটিতে দাঁড়ানো এমভি আল-আব্বাস, এসেছে ৯ই আগস্ট। ১২ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা এই জাহাজ ১০,৪১০ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে। এমভি হরমুজ ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। এর সঙ্গে রয়েছে ৯,৯১০ টন সমরাস্ত্র। ১৩ নং জেটিতে তা ভেড়ানো।
একখানি বার্জে ২৭৬ টন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই করে মৎস্য বন্দরের জেটির সামনে রাখা হয়েছে। এটাকে ট্রেনে করে ঢাকায় পাঠানো হবে। মাথাটা পানির ওপরে রেখে বাংলাদেশের কমান্ডো ছেলেরা পৌঁছে যায় যার যার লক্ষ্য বস্তুতে। সময় নষ্ট না করে জাহাজগুলোর গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দিয়েই আবার তেমনি নিঃশব্দে নদীর ভাটিতে ভেসে যায় তারা। আরও দক্ষিণে সরে গিয়ে তারা পূর্ব তীরে উঠে পড়ে। রাত পোহাতে তখনো অনেক বাকী। নিরাপদ দূরত্বে চলে যাবার পর্যাপ্ত সময় তারা পেয়ে যায়। সকাল হলে তারা পটিয়া পৌঁছাবে। এবং সেখানে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে ১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। 

রাত ১টা ৪০ মিনিট। হঠাৎ কান ফাটান শব্দে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেঁপে ওঠে। 
তারপর ১ টা ৪৫ মিনিট। আরেকটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ। তারপর একে একে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম। একটির পর একটি বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম তখন থর থর করে কাঁপছে। আতংকে  পাকিস্তানী সেনারা দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলি চালাতে আরম্ভ করে। ৬ নম্বর ওরিয়েন্ট বার্জ দেখতে না দেখতে তলিয়ে যায়। আল-আব্বাস ও হরমুজও দ্রুত ডুবে যেতে থাকে। জাহাজের খোলে প্রচÐ জোরে তখন পানি ঢুকছে। বিস্ফোরণে জাহাজের ক্রুরাও আহত হয়েছে। 

পরদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধŸতন পাকিস্তানী নৌ ও সেনা অফিসাররা চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে হাজির হলেন। 
 
সারা এলাকায় কাফর্‚ জারী করা হলো। মুক্তি বাহিনীর খোঁজে হেলিকাপ্টারগুলো তখন আকাশে ওঠেছে। পাকিস্তানীরা তাদের প্রতিশোধ নিতে তখন বন্দরের পূর্ব পাড়ের জনপদের ওপর নির্বিচারে কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। নদী পাড়ের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। সন্দেহের কারণে নিরাপরাধ গ্রামবাসী এবং জেলেদের ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর খবর বের করার চেষ্টা করে। রাজাকাররাও এ কাজে সহায়তা করে। গ্রামবাসী যুবতী গৃহবধূদের ধরে আনা হয়। এদের মধ্যে দু’জন যুবতী ছিল পোয়াতী। রাজাকার ও খানসেনারা তাদের ইতরের মতো নগ্ন করে দেয়। একজন যুবতী গর্ভবতী গৃহবধূকে জোর করে ধর্ষণ করে শতাধিক খানসেনা। বেচারীর সঙ্গে সঙ্গে গর্ভপাত ঘটে। অন্য গর্ভবতী যুবতীকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে রাজাকাররা তার পেটে পায়ের চাপ দিয়ে বাচ্চা বের করে দেয়। গ্রাম থেকে ধরে আনা নিরীহ মানুষগুলোর কাছে কিছু না পেয়ে নদীর পাড়ে তাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিরাপরাধ, নিরস্ত্র গ্রামবাসী, জেলে আর যুবতী মেয়েদের রক্তাক্ত লাশগুলো স্রোতের টানে সমুদ্রের দিকে ভেসে চলে। 

পটিয়াতে তখন নৌ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিচ্ছে। তারা অত্যন্ত বিপদজনক ও জটিল অপারেশন সফলতার সঙ্গে করতে পারলেও তাদের কাজের জন্যে প্রাণ দিল নিরীহ গ্রামবাসী। তবে এই নিরীহ গ্রামবাসীর কথা কোন ইতিহাসে স্থান পায় না। এটাই নিয়ম। অনেক-অ-নে-ক সাধারণ মানুষের সংসারকে তছনছ করেই না’কি বিপ্লব সার্থক হয়- আসে স্বাধীনতা। তারপর আবার সেই স্বাধীনতাকে জিম্মি করে চলে আরও রক্তপাত, আরও হত্যা, আরও জিঘাংসা। পারভেজের চোখ ভিজে উঠে। কোন উত্তর, কোন সমাধান সে খুঁজে পায় না। (চলবে)

[ধারাবাহিক উপন্যাস ‘দুই নগরের উপাখ্যান ’ রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। উপন্যাসের চরিত্রসমূহ কাল্পনিক।  কোন জীবিত বা মৃত মানুষের জীবনের সাথে এর কোন সাদৃস্য পাওয়া যাবে না। পটভূমি ঐতিহাসিক হওয়াতে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাসের সঙ্গে হুবহু মিল নাও পাওয়া যেতে পারে।]

পাঠকের মন্তব্য


একই ধরনের লেখা, আপনার পছন্দ হতে পারে

bdjogajog