জিন্দা লাশ
পর্ব-৪
বেচারা আবিদ মন্ডল। তার নিজের ছেলেরা তাকে আটকে রেখেছিল মাস্তানদের দিয়ে। দু’বেলা শুধু কিছু খাবার দিয়ে যেত তারা। একদিন হঠাৎ খাবার দেয়াও বন্ধ হয়ে গেল। আবিদ মন্ডল বন্ধ দরজায় অনেক ধাক্কা দিল। ডাকডাকি করলো, কিন্তু কেউ কোন সারা দিল না। আস্তে আস্তে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আবিদ মন্ডল অস্থির অবস্থা থেকে ক্রমে ঝিমিয়ে পড়তে লাগলো। হয়তো তিন-চার দিন এভাবেই গিয়েছে। আবিদের মনে নেই।
একদিন রাত ভোরের আবছা অন্ধকারে সে দেখলো ঘরের বন্ধ দরজাটা যেন অর্ধেক খোলা। বাইরের পৃথিবীতে তখন ভোর হচ্ছে। পূবের আকাশটা বিচিত্র রঙে রঙিন হয়ে উঠছে। পৃথিবীতে কোন মানুষ কোনো দিন বন্দি হয়ে থাকতে চায় না। তবুও মানুষকে বন্দি হতে হয়। কেউবা অপরাধ করে, বন্দি হয়। কেউ প্রতিবাদ করায় বন্দি হয়। কেউবা বিনাদোষে বন্দি হয়। আবিদ মন্ডল কোন অপরাধে বন্দি হল? আপন ছেলেদের অন্যায় দাবি না মানার অপরাধে? না’কি এই সমাজ এবং রাষ্ট্র তাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সেই কারণে?
মানুষ কথা বলতে চায়। পাখিরা মনের আনন্দে এই মুহূর্তে ভোরের সূচনা লগ্নে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসায় গেয়ে উঠছে। মানুষ কি কোন দিন সৃষ্টি কর্তার প্রশংসায় গেয়ে ওঠে নিঃস্বার্থভাবে? উঠতে পারে? আবিদ মন্ডলের দু’টি চোখ আজ মনের আনন্দে নেচে ওঠে। সে বাইরে যাবে। দু’চোখ ভরে দেখবে আল্লাহ’র এই দুনিয়াকে। যেই দুনিয়া তাকে দেখতে দেয়নি তারই ঔরষজাত ছেলেরা। বাবাকে তারা বন্দি করেছে মাস্তান লাগিয়ে। অথচ বাবারা কত কষ্টে, কত আনন্দে, কত মমতায় তাদের সন্তানদের লালনপালন করে। বাবার পিঠে চড়ে সন্তানরা প্রথম যেন পাহাড়ে ওঠার আনন্দ উপভোগ করে। আর সেই সন্তানই, হয়তোবা সবাই নয়, বড় হলে বাবাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।
দীর্ঘদিন বন্দি থাকা আবিদ মন্ডলএখন দরজার বাইরে। বাইরে পূব আকাশে এক শিল্পী যেন আশ্চর্য সব রঙে আকাশকে রাঙিয়ে তুলছেন। সে রঙের সমারোহ কোন চারুকলায় পড়া শিল্পীর দেখাশোনা নেই। আঁধার রাজ্যে এখন পূর্ণোদমে সকালের আর্বিভাব সংবাদ এসে পেীঁছেছে। আজকের সকাল কী আবিদ মন্ডলের জীবনকে বদলে দেবে?
পলাশপুকুরের আবিদ মন্ডল। বিবাহিত জীবন তার শুরু হয়েছিল পরিবিবিকে নিয়ে। সুন্দরী বউ ছিল তার। সুখের সংসার। মোটামুটি অবস্থাপন্ন পরিবারিক জীবন ছিল তার। একটি মেয়ের খুব শখ ছিল তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চার চারটি পুত্র সন্তানের বাবা হল সে।
আবিদ মন্ডলের ছোট ছেলে হাফিজের জন্মের সময়ই মারা যায় স্ত্রী পরিবিবি। তারপর দীর্ঘ পনেরো-বিশ বছর পার হয়ে গেছে। কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল আবিদ মন্ডলের। আজ সে পঞ্চাশ উর্ধ্ব প্রবীণ মানুষ। পুত্রদের কারণে ঘর ছাড়া সর্বহারা মানুষ। পুত্রদের কাছেও আজ সে মৃত। স্ত্রী পরিবিবি কী ওপর থেকে সব দেখছে। মৃত্যুর পর কি মানুষের আত্মার অবাধ চলাচল থাকে!
মৃত স্ত্রীকে বহুবার স্বপ্নে দেখেছে আবিদ মন্ডল। স্বপ্নে এসে তার বউ কতবার বলেছে, তোমার ছেলেরা বিষয় সম্পত্তিতে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠছে। ওদের সময় থাকতে সামলাও। আসলেই আমাদের একটা মেয়ে যদি হতো। আক্ষেপ করে বলেছিল পরিবিবি। মেয়ে সন্তান হলো ঘরের লক্ষ্মি। জানো তো, যার মেয়ে সন্তান জন্ম নেয় তার বাড়িতে ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয়ে দোয়া পড়তে থাকে। পরিবিবি বলে চলে, আমার বাবা বলতেন, হাদিসে না’কি বলা আছে, ওই স্ত্রী তার স্বামীর জন্য বেশি বরকতময় যার প্রথম সন্তান হয় মেয়ে। কন্যা সন্তান আল্লাহতালার রহমত স্বরূপ আসে। ভাগ্যবানদের আল্লাহ নেয়ামত হিসেবে উপহার দেন কন্যা সন্তান।
আবিদ মন্ডল হয়তো ভাগ্যবান শ্রেণীভুক্ত নয়। তা’নাহলে তার ভাগ্যে এমন ঘটলো কেন? (চলবে)