সাম্প্রতিক প্রকাশনা

দুই নগরের উপাখ্যান

আলতামাস পাশা লেখাটি পড়েছেন 1220 জন পাঠক।
 [ধারাবাহিক উপন্যাস ‘দুই নগরের উপাখ্যান ’ রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। উপন্যাসের চরিত্রসমূহ কাল্পনিক।  কোন জীবিত বা মৃত মানুষের জীবনের থাকে এর কোন সাদৃস্য পাওয়া যাবে না। পটভূমি ঐতিহাসিক হওয়াতে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাসের সঙ্গে হুবহু মিল নাও পাওয়া যেতে পারে।]

প্রথম পর্ব  

“What a piece of work is a man, 

How noble in reason! How infinite in faculties!  

Inform and moving, how express and admirable! 

In action, how like an angle, In appreciation, how like a God!”  

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের বোয়িং ৭৮৭ এইমাত্র ল্যান্ড করেছে। প্যাসেনজাররা সব একে একে প্লেন থেকে নামছে। ঢাকার আকাশ পৌষের ¯িœগ্ধ রোদে হাসছে। প্লেনের দরজা দিয়ে এবার বেরিয়ে আসলো মাথা ভরা সোনালী চুলের মেয়ে রিন্ডি গ্রে। লিন্ডার আশ্চর্য সুন্দর নীল চোখজোড়া পরম বিস্ময়ে দেখতে লাগলো ঢাকা বিমান বন্দরটাকে।  

প্রায় ২২ বছর পর লিন্ডা বাংলাদেশে আসলো। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ ছেড়ে লিন্ডা যখন চলে যায় তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর। এই এয়ারপোর্ট তখন ছিল না। তেজগাঁও এয়ারপোর্টে হুইলচেয়ারে করে এসে রায়হান তাকে বিদায় জানিয়েছিল। কিছুটা যেন নস্টালজিয়াই পেয়ে বসে লিন্ডাকে। আর তাই এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতাও  খানিকটা ঘোরের মধ্যে শেষ করতে হয় তাকে।  

কাঁধে সোল্ডার ব্যাগ আর হাতে একটা মাঝারি সাইজের সুটকেশ নিয়ে লিন্ডা এয়ারপোর্টেৃর ট্যাক্সি স্টান্ডে এসে দাঁড়ায়। হই-চই- করে এগিয়ে আসে ট্যাক্সি ডাইভারগুলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে লিন্ডার কোথায় যাবে তা জানতে চায়, শেরাটন ম্যাডাম? অনলি ফাইভ হান্ডরেড টাকা। এতজনের এত কথা লিন্ডার মাথায় ঢোকে না। মোটামুটি কম হইচই করছে এমন একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে লিন্ডা জিজ্ঞেস করে, ‘পল্টন, যাবে কিনা ?’
- ’ইয়েস, সেভেন হান্ডরেড টাকা অনলি। লিন্ডা রওয়ানা হয়ে যায়। লিন্ডার দরদাম করতে আর একটুও ইচ্ছা হয় না। লিন্ডাকে নিয়ে ট্যাক্সিটি দ্রুত এয়ারপোর্ট রোডের সুরম্য রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। ট্যাক্সির বাইরে ঢাকার ব্যস্ত রূপ লিন্ডাকে মুগ্ধ করতে পারে না।  

তার বারবার মনে হয় কি যেন সে হারিয়ে ফেলেছে এই দেশে। লিন্ডার কানে অনুরণিত হতে থাকে, ‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।  
---------------------    ------------------ --------------- -----------------

১৯৭১ সাল, ১৭ এপ্রিল। কুষ্টিয়ার মেহেরপুর আম বাগানে সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বেশ কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকের সঙ্গে লিন্ডার বাবা এডমন্ড হাসলারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৭ বছরের উচ্ছল তরুণী লিন্ডা সেখানে উপস্থিত ছিলো ওর বাবার সঙ্গে জেদ করে। বাংলাদেশ এবং সে দেশটির মানুষ সম্পর্কে জানার অসীম কৌতূহল তখন লিন্ডার। তাই বাবার অনেক নিষেধ স্বত্বেও লিন্ডা মেহেরপুরে যায়।  

আম বাগানে ঘেরা প্রকৃতির এক শান্ত নির্মল পরিবেশে সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। যে কোন বিদেশী সাংবাদিকের জন্যেই এ খবর সংগ্রহ করা, দুর্লভ মুহূর্তের ফটো তুলে রাখা ছিল বিশাল গৌরবের ব্যাপার। লিন্ডার বাবা তখন জার্মান টেলিভিশনের সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করছিলেন ভারতে। এর আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অচল অবস্থা দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ঢাকা চলে যান। 

১৯৭১ সাল। মার্চের ৩ তারিখ। মিছিলে, প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা শহর। আওয়ামী লীগের বিশেষ সভা চলছে হোটেল পূর্বানীতে। উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা অন্যায়ভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। কারণ এটি তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা শাসন ক্ষমতা বাঙালির  হাতে তুলে দেবে না। দিন এগিয়ে চলে দ্রুত। ঢাকার প্রতিটি সকাল জন্ম দেয় নতুন নতুন ঘটনার। নতুন নতুন কাহিনীর। কার্ফ্যু ভেঙ্গে লাখ লাখ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। সরকারি কর্মচারীরা অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন। সে এক জেগে ওঠার ইতিহাস। সে এক অন্য রকম কাহিনী। সারা বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্যে পাগল হয়ে উঠলো।  

সাংবাদিক এডমন্ড হাসলার ঢাকা থেকে জার্মানীর মিউনিখে মেয়ে লিন্ডার কাছে সেসব খবর লিখে পাঠাতেন। বাবার চিঠি পড়ে লিন্ডার বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলছিল। তারপর ২৫শে মার্চের ঘটনার পর লিন্ডা আর দেরী না করে দিল্লি চলে আসে।  

এদিকে ২৫শে মার্চের গণহত্যার পরে সব বিদেশী সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বের করে দিলে লিন্ডার বাবা কলম্বো হয়ে দিল্লি চলে যান। তারপর লিন্ডাকে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন। কলকাতায় আসার উদ্দেশ্য ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান করে টাটকা খবর সংগ্রহ করা আর প্রয়োজনে আগরতলা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে গণহত্যার তাৎক্ষণিক খবর সংগ্রহ আর ফটো নেয়া।  

বাবার সঙ্গেই রায়হানকে প্রথম দেখেছিল লিন্ডা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লিন্ডার সঙ্গে রায়হানকে পরিচয় করিয়ে যেন বাবা। কিশোরী লিন্ডার কাছে রায়হান এক চরম বিস্ময় ছিলো। গভীর কালো চোখে, কোঁকড়ানো কালো চুলের বাঙালি ছেলেটি জার্মান মেয়ে লিন্ডাকে বলেছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কথা। লিন্ডা অল্প অল্প ইংরেজি জানায় রায়হানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগে নি। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদ লিন্ডাকে উপহার দিয়েছিল রায়হান। ইংরেজি লাইন ক’টি বারবার পড়তে ভালোলাগতো লিন্ডার। আজও লিন্ডার মনে রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনগুলো মিশে আছে গভীর অনুভূতি আর মমতায়, “When I go from hence let this be my parting word, that what I have seen is unsurpassable”....................................................  . 


 দিস ইজ পল্টন, হউচ ওয়ে প্লিজ? ট্যাক্সি ড্রাইভারের জিজ্ঞাসায় লিন্ডা বাস্তবে ফিরে আসে। রাস্তা সব অচেনা লিন্ডার কাছে। কোন দিকে সে যাবে ভেবে পায় না। তারপর মনে পরে বাড়িটার সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল আর সাইন বোর্ডে লেখা ছিলো “....” ট্যাক্সি ড্রাইভারকে লিন্ডা বাড়ির সাইন বোর্ডটার কথা বলে। ট্যাক্সি ড্রাইভার বাড়িটা চেনে। কিন্তু সে আপন মনে বলে উঠে, ঐ বাড়িতে এখন কেউ আছে না কি? কয়েকটা হুইল চেয়ারে বসা মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া আর কেউ সেখানে নেই। অনেকের  পরিবারও তাদের ছেড়ে চলে গেছে। এখনকার অবস্থা দেখে মনে হয় না এই দেশ কোনদিন মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। লিন্ডা লোকটার কথা সব বুঝতে না পারলেও এটুকু বোঝে মুক্তিয্দ্ধু, মুক্তিযোদ্ধা এসব নিয়েই সে কথা বলছে।  

ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বেশ দক্ষ বলতে হবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাড়িটা খুঁজে বের করে লিন্ডাকে সে যথাস্থানে পৌঁছে দিল। ভাড়া মিটিয়ে জরাজীর্ণ বাড়িটার গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় লিন্ডা গ্রে। বাড়ির ভেতর নিঃস্তব্ধ। কেউ আছে বলেও মনে হয় না। লিন্ডা তাই গেটের পাশে কলিং বেলে হাত দেয়। কতকালের পুরানো কলিংবেল কে জানে? সুইচটা অনেকক্ষণ ধরে রেখেও কোন কাজ হয় না। লিন্ডার নজরে পরে তার একটা ছিঁড়ে আছে। অতত্রব গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করা ছাড়া পথ আর খোলা থাকে না। ভেতরে ঢুকে  প্রথম ঘরটাতে কাউকেই পাওয়া যায় না। দরজার কড়া ধরে নাড়ে লিন্ডা। প্রচ- কাশতে কাশতে এগিয়ে আসে একজন। লিন্ডা লক্ষ্য করে লোকটির দু’টি হাতই নেই। বিদেশী দেখে আগত লোকটি একটু চমকায়। ভাঙ্গা বাংলায় লিন্ডা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘রায়হান আছেন?’  

-রায়হান?
-‘ইয়েস, ফ্রিডম ফাইটার রায়হান আহমেদ’?
-‘ফ্রিডম ফাইটার’? আর ইউ কিডিং’?
-‘নো আই এম নট’? বাট আই রিয়্যালী ওয়ান্ট টু মিট উইথ হিম!
-বাট রায়হান ইজ নট হিয়ার’!
-‘হোয়ার উইল আই ফাইন্ড হিম’? 
লিন্ডাকে লোকটা জানায়, রায়হান বহুদিন এ বাড়িতেই ছিল। তবে আজ প্রায় আট-নয় মাস হতে সে উধাও হয়ে গেছে। এ ভাঙা বাড়িটাও আর থাকছে না। পাশেই বহুতল ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। সব পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাই এখন মোহাম্মদপুরের আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছে। লিন্ডাকে লোকটি সেখানেই খবর নিতে পরামর্শ দিল। কিন্তু লিন্ডা চলে যায় না। রায়হানের খবরদাতা লোকটি সম্পর্কে সে আরও জানতে চায়। নিজের সম্পর্কে বলতে লোকটির আগ্রহ সামান্যই। অবশ্য রায়হানের সর্বশেষ মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে লিন্ডা।  

মোহন নামের লিন্ডার অপরিচিত এ মুক্তিযোদ্ধা ’৭১ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তবে রায়হানের সঙ্গে পরিচয় এ আশ্রয় কেন্দ্রে এসে। প্রবল আতœবিশ্বাসী মানুষ ছিল রায়হান। ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষ এবং ’৭৫ এ শেখ মুজিবকে সপরিবারে নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড রায়হানকে ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত করে তোলে। 

সে সময় রাতটা রায়হানের কাছে অসহ্য মনে হতো। সন্ধ্যা হতেই শুরু হতো এক ধরণের অস্থিরতা। রায়হানের মনে হত সূর্যটাকে যদি আরও একটু সময় ধরে রাখা যেতো! প্রথমদিকে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতো রায়হানের, জেগে আর চিন্তা করে কাটিয়ে দিত বাকি রাত। কিন্তু শেষের দিকে ঘুমাতেই পারতো না সে। ঘুমের ওষুধেও কাজ হয় না। ইজিচেয়ারে আধশোয়া রায়হান দূরের মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যে ভাবতো কে জানে। তার কতো স্মৃতি । মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। কর্ণফুলী নদীর বুকে সাম্পান করে মৃন্ময়ী চাকমার সঙ্গে ভেসে যাওয়া, রাবার বাগানে ছুটোছুটি ..... প্রকৃতিকে নষ্ট করার জন্য রাবারের চাষ রায়হানের কোন দিনই ভালো লাগেনি। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সেই কাজটিই হয়েছে মহা উল্লাসের সঙ্গে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়।....  

আর সেই যুদ্ধের দিনগুলো! কি ভয়ংকর, বিভীষিকাময় যুদ্ধ। প্রাণপণ লড়াই। অবশেষে বিজয়। কি অনাবিল আনন্দ। কোন কোন রাত রায়হানের জন্যে হয়ে উঠে দুঃসহ। মনে হয় সেই লোকটির কথা। তাদের গ্রাম তছনছ করেছে যে। আজও ঐ লোকটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে রায়হান। তাকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত শান্তি নেই রায়হানের। আজও নিঃশব্দ-নিঝুম কোন রাতে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রায়হান ইজিচেয়ারে আধশোয়া। তাকিয়ে আছে ঐ দূর আকাশের দিকে। মেঘ সরে গিয়ে একটু একটু করে বেরিয়ে আসবে কি মুক্তির আলো? কিন্তু সেই লোকগুলো আবারও এগিয়ে আসছে.... গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে সেই লোকগুলো আবারও তৈরি হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, বিজয়ের পরে তারা আক্রোশে শপথ নিয়েছিল ত্রিশ বছর পর হলেও এ পরাজয়ের প্রতিশোধ তারা নেবেই। 
চলবে.....

[ধারাবাহিক উপন্যাস ‘দুই নগরের উপাখ্যান ’ রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। উপন্যাসের চরিত্রসমূহ কাল্পনিক।  কোন জীবিত বা মৃত মানুষের জীবনের সাথে এর কোন সাদৃস্য পাওয়া যাবে না। পটভূমি ঐতিহাসিক হওয়াতে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাসের সঙ্গে হুবহু মিল নাও পাওয়া যেতে পারে।]

পাঠকের মন্তব্য


আলো : Excellent !

একই ধরনের লেখা, আপনার পছন্দ হতে পারে

bdjogajog