সাম্প্রতিক প্রকাশনা

বাংলাদেশে নিকট ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের আশংকা কম না বেশি? সচেতন না করে আতংক ছড়াবার কারণ কি?

Shaon Ahmed লেখাটি পড়েছেন 1231 জন পাঠক।
 [সাধারণত, বড় ধরনের ভূকম্পন হয়ে থাকে প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে নয়, তথাপি ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান ও বিন্যাসের স্বকীয়তায় ভূমিকম্প মণ্ডলের আশপাশেই রয়েছে দেশটি। ]

ছোট্ট ছেলে রিপন। বয়স হবে নয় কি দশ বছর।সেদিন রাতে ঘুমের মধ্যে চমকে গিয়ে চিৎকার করে জেগে ওঠে।তার মা অবাক হয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে? পরে জানা গেল সম্প্রতি টেলিভিশন আর ইউটিউবের মাধ্যমে সে দেখেছে এবং শুনেছে ভূমিকম্পে ঢাকা মহানগরী ধ্বংস হয়ে যাবে।বেচারার শিশু মন তাই অজানা আতংকে শিহরিত হচ্ছে।আমাদের দেশের মিডিয়া এখনও খবর কীভাবে পরিবেশন করতে হয় তা বোঝে না। যে খবর শিশু-বৃদ্ধ সবাই দেখছে তা যথাযথভাবে পরিবেশন করা প্রয়োজন।যেসব খবর সচেতনতার চেয়ে আতংকের উদ্রেগ করে তা কি উপস্থাপনার কৌশল পাল্টে উপস্থাপন করা উচিত নয়?

বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটে। এই প্লেটের পাশে রয়েছে বার্মিজ সাব প্লেট ও ইউরোশীয় প্লেট। বাংলাদেশের পূর্ব, উত্তর-পূর্ব, উত্তরে ওই দুটি প্লেটের সীমান্ত বা বাউন্ডারী। তবে এই সবকটি সীমান্ত ফাটলই বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের সূত্রে জানা যায় এইসব প্লেট বাউন্ডারীগুলো বাংলাদেশের ভিতরে না থাকায় ওই উৎস থেকে বড় ভূমিকম্পের আশংকা কম। তবে প্লেট সীমান্তে বা বাউন্ডারীতে বড় কোন ভূমিকম্প হলে তার প্রভাব দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ভাবে পড়বে। কোন ভূতাত্বিক অথবা সিসমোলজিস্ট এর পক্ষেই এটি বলা সম্ভবপর নয় যে ভূমিকম্প ঝুঁকির মাত্রা কত হবে বা ওই ভূমিকম্প আসন্ন কিনা বা কবে হবে। এসম্পর্কে মার্কিন জিওলজিক্যালি সার্ভে এজেন্সির সিসমোলজিস্ট ড. লুসি বলেছেন,‘ There does not yet exist a way to predict the time when an earthquake will strike.’

একথা হয়তো সত্য যে, প্লেট বাউন্ডারীতে বা ফল্ট লা্ইনে ভূতাত্বিক অথবা সিসমোলজিস্টদের অনুমানে পরিসংখ্যানগতভাবে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। তবে তা কবে ভূমিকম্পের রূপ নেবে তা বলতে পারেন একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।তিনি আমাদের সহায় হোন যাতে আমরা অকারণ আতংক না ছড়িয়ে সব ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণিপেশার মানুষকে ভূমিকম্পের আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সচেতন করতে পারি। বিপদে ধৈর্য্য ধারণ ও তা থেকে উদ্ধার পাবার উপায় খোঁজাও ইমানের লক্ষণ।

বাংলাদেশের টেকটোনিক কাঠামো এবং সংযুক্তকারী এলাকাসমূহ নিদের্শনা দেয় যে, বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ভারতীয় এবং ইউরোশীয় প্লেট বাউন্ডারির কাছাকাছি।এদুটি প্লেট বাউন্ডারিতে অতীতে বেশ কয়েকটি ধ্বংষকারী ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। এক কথায় বাংলাদেশ উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় অবস্থান করছে।অতীতে ইউরোশিয়ান প্লেটের অংশ ছিল বাংলাদেশ। যখন ভারতীয় প্লেটটি এশিয়া প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা খায় তখন বাংলাদেশের বর্তমান ভূভাগ ইউরোশীয় প্লেট থেকে পৃথক হয়ে যায়।বর্তসানে এটি ভারতীয়, সুন্ডা, অস্ট্রেলিয়ান এবং ইউরোশীয় প্লেটের দ্বারা বেষ্টিত।

সিলেটের ডাউকি ফল্টটি হচ্ছে শিলং উপত্যকার দক্ষিণা্ংশের সীমানার প্রধান ফল্ট যা চার পাশের এলাকায় বিধ্বংসী ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে বলে বাংলাদেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন। পাশাপাশি ঢাকার কাছে মধুপুরেও একটি এধরণের ফল্ট আছে বলে মনে করা হয়। এমনও মনে করা হয় যে, এই ফল্টটি ঢাকা শহরের জন্য বিপদজন হতে পারে। 

তবে ভূ-তত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর সাপ্তাহিক ২০০০ এ তার এক প্রতিবেদনের বলেছিলেন, “বিস্তর অনুসন্ধানে মধুপুরে কোন ফল্টের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি।১৮৮৫ সালে টাঙ্গাইলে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ায় সম্ভবত সেই ভূমিকম্পের নজির দেখিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভুল করে মধুপুর ফল্টের কথা উল্লেখ করেছেন।তাছাড়া মর্গ্যান ও ম্যাকেন্টারের টেকটনিক কারণে মধুপুর এলাকা ওপরে উঠার ধারণাও সঠিক নয়।দশ হাজার বছর আগে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে ভূমিতে যে ক্ষয়সাধন হয়েছে তারই সৃষ্ট খাদ এখন সিসমিক সার্ভেতে লিনিয়েশন আকারে দেখা যায়।বিষয়টি মোটেও টেকটোনিক নয়। মধুপুরে যেহেতু কোনও ফাটলেরই অস্তিত্ব নেই, তাই সেখানে ভূমিকম্পের এপি সেন্টার হওয়ারও সম্ভবনা নেই। ঢাকাবাসীর আতংকিত হওয়ারও কারণ নেই”। 

অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর আরও বলেছিলেন,“ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিক থেকে ঢাকার কাছাকাছি ভূ-কম্পনের কেন্দ্রস্থল না থাকায় ঢাকা শহর ঝুঁকিপূর্ণ্ নয়।ঢাকায় বড় ধরনের কোন ভূমিকম্পের নজিরও নেই। তবে রিখতার স্কেলে ৬ থেকে ৭ মাত্রা্র বেশি ভূমিকম্প হলে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি হবে ব্যাপক। কারণ এখান বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি করে ও অপরিকল্পিতভাকে বাড়িঘর বানিয়ে ঢাকাকে একটি ঘিঞ্জি নগরীতে পরিণত করা হয়েছে।তিনি আরও দাবি করেছিলেন, মধুপুর ফল্ট, যমুনা ফল্ট এবং বংশীতে চ্যুতির বিষয়টিও বাস্তবতাবর্জিত। (সাপ্তাহিক ২০০০,বর্ষ-১২, সংখ্যা-২৩)।

প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী পত্রিকান্তরে আলাপকালে বলেছিলেন যে, তারা মধুপুরে একটি চ্যুতির সন্ধান পেয়েছেন। তবে বিগত এক-দেড়শ বছরে এটি সক্রিয় হয়ে উঠেনি।এটি সক্রিয় হয়ে উঠলে ঢাকা শহরের ব্যাপক ক্ষতি হবে।তিনি আরও বলেছিলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প হলেই যে বড় আকারের ভূমিকম্প হবে এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এমনকি ভূমিকম্পের একশ-দেড়শ বছরের সাইকেল তত্বটিও তিনি বিশ্বাস করেন নি।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ধারণা করতেন, এক্ই মা্ত্রার ভূমিকম্প হলেও সিলেট বা চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা হবে বেশি।এর প্রধান কারণ ঢাকার জনসংখ্যার ঘণত্ব ও বহুসংখ্যক বাড়িঘর। বাড়িঘরের অধিকাংশই অপরিকল্পিত বলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এগুলোর বেশির ভাগই ভেঙ্গে পড়বে।

সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) এক গবেষণা জরিপে উল্লেখ্ করে ছিল যে, ঢাকায় ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রায় ৭৮ হাজার। এর মধ্যে সরকারি ভবনের সংখ্যাই প্রায় ৫ হাজার।এ সংখ্যা এখন আরো বৃদ্ধি পেলেও কোন সমন্বিত উদ্যোগ নেই ঝুঁকি কমিয়ে আনার।যদিও বিশেজ্ঞরা মনে করেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য আগাম ব্যবস্থা হিসেবে সরকারি ভবনগুলোতে ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

আমাদের আলোচনায় এটি ক্রমশই স্পষ্ট হয়েছে যে, ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। দেশের ভেতরে ও সীমানা ঘিরে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার মতো একাধিক ফাটলরেখা (টেকটোনিক প্লেট বাউন্ডারি চ্যুতি বা পিবিএফ) রয়েছে। এ ছাড়া রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো ফাটলরেখা রয়েছে দেশের মধ্যেও। তাই ভূমিকম্প নিয়ে সাবধান হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশে পরিচালিত দেশি-বিদেশি একদল বিশেষজ্ঞ গবেষকের একটি যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনেও এমনটি বলা হয়েছিল। দলটিতে জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের কয়েকজন গবেষক কাজ করেছেন। অবশ্য তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য আপাত স্বস্তির কথাও ছিল। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরের সন্নিহিত অঞ্চলে অনেকগুলো ফাটলরেখা থাকলেও নিকট ভবিষ্যতে সেগুলো বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্পের উৎসস্থল (এপিসেন্টার) হওয়ার আশঙ্কা কম।

‘টাইম প্রেডিক্টেবল ফল্ট মডেলিং ফর সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণা

‘টাইম প্রেডিক্টেবল ফল্ট মডেলিং ফর সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক এই গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০০৯-১০ সালে। দেশের ভেতরে ও সীমানাসংলগ্ন অঞ্চলের ফাটলরেখায় (পিডিএফ) ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা নির্ধারণ ছিল এই গবেষণার বিষয়। গবেষণায় বলা হয়, এ অঞ্চলের পিডিএফগুলোতে আগে যত সময়ের ব্যবধানে একেকটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে, সেই হিসাব অনুযায়ী নিকট ভবিষ্যতে তেমন কিছু হওয়ার কথা নয়। তবে পিডিএফ ছাড়া যে ফাটলরেখাগুলো আছে, বিশেষ করে ডাউকি ও মধুপুর ফাটলরেখা, সেগুলো অদূর ভবিষ্যতে মধ্যম মাত্রার (রিখটার স্কেলে ৭ পর্যন্ত) ভূমিকম্পের উৎসস্থল হতে পারে। এ ছাড়া অচিহ্নিত কিছু ফাটলরেখা থাকাও অস্বাভাবিক নয়।

সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) অধীনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা ডিএফআইডি এই গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর (প্রয়াত) নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল গবেষণার প্রতিটি পর্যায় পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছিলেন। দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সফিউল্লাহ, অধ্যাপক মেহেদী আহম্মেদ আনসারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফতাব আলম খান ও একই বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হক (প্রয়াত)। গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ, বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও সিডিএমপির তৎকালীন জাতীয় বিশেষজ্ঞ  এ এস এম মাকসুদ কামাল।

সম্ভাব্য ভূমিকম্পের জন্য বিপজ্জনক ফাটলরেখাগুলো: 

ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে সদা সঞ্চরণশীল পূর্বোক্ত পিবিএফ। বাংলাদেশের অবস্থান ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটে। এই প্লেটের দুপাশে রয়েছে ইউরেশীয় প্লেট ও বার্মিজ সাব-প্লেট। বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও পূর্বে ওই দুটি প্লেটের প্রান্তসীমা। এই প্লেটগুলোর প্রান্তবর্তী অধিকাংশ ফাটলরেখাই বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে কিংবা সংলগ্ন এলাকায়। ফলে এসব ফাটলরেখায় বড় কোনো ভূমিকম্পের সৃষ্টি হলে দেশের মধ্যে তার প্রভাব বিধ্বংসী হবে। তাই সাবধানতা ও সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে। এই গবেষণায় বলা হয় যে, স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে এসব ফাটলরেখা বড় ভূমিকম্পের উৎস হওয়ার সম্ভাবনা কম।

গবেষকেরা বাংলাদেশ-সংলগ্ন পিবিএফগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন—পিবিএফ-১, পিবিএফ-২ ও পিবিএফ-৩। এগুলোতে বড় ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। 

পিবিএফ ছাড়াও দেশের মধ্যে অন্তত দুটি বড় ফাটলরেখা রয়েছে। একটি ডাউকি, অপরটি মধুপুর ফাটলরেখা। এর মধ্যে মধুপুর ঢাকার জন্য বিপজ্জনক। অতীতে পিবিএফ এবং এ দুটি ফাটলরেখা থেকে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতেও হতে পারে। তবে এই ফাটলরেখা নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মাঝে যে মতবিরোধ রয়েছে তা এই নিবন্ধে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ভূমিকম্প কবে হতে পারে: 

গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল উপরে উল্লিখিত ফাটলরেখাগুলোতে ভূমিকম্প কবে হতে পারে তার সম্ভাব্যতা নির্ণয় করা। এ জন্য উক্ত পাঁচটি ফাটলরেখার প্রতিটির আলাদা আলাদা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করে তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে কয়েকটি জায়গায় পরিখা খনন করে এবং ফাটলরেখা থেকে সংগৃহীত কাঠ ও অন্যান্য বস্তুকণার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই ফাটলরেখাগুলো থেকে সৃষ্ট অতীতের একাধিক ভূমিকম্পের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান (রেকারেন্স পিরিয়ড) নির্ধারণ করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, তিনটি পিবিএফেরই রেকারেন্স পিরিয়ড ৯০০ বছর। অর্থাৎ এই ফাটলরেখাগুলো অতীতে যেসব বিধ্বংসী ভূমিকম্পের (রিখটার স্কেলে সাড়ে সাত বা তার বেশি মাত্রার) উৎপত্তিস্থল হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে, এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান হবে ৯০০ বছর।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পিবিএফ-১ থেকে সর্বশেষ বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল ২৪৬ বছর আগে। পিবিএফ-২ ও পিবিএফ-৩ থেকে হয়েছিল ৫০৮ বছর আগে। কাজেই রেকারেন্স পিরিয়ড (৯০০ বছর) শেষ হয়ে এই ফাটলরেখাগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিধ্বংসী ভূমিকম্প (ক্যারেক্টারস্টিক আর্থকোয়েক) সৃষ্টি হতে এখনো বহু বছর বাকি।

পিবিএফ ছাড়া ডাউকি ফাটলরেখায় সর্বশেষ বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে, এখন থেকে প্রায় ১১৮ বছর আগে। গবেষণায় নির্ণিত ডাউকির রেকারেন্স পিরিয়ড ২৫০ থেকে ৩৫০ বছর। মধুপুর ফাটলরেখায় সর্বশেষ বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয় ১৮৮৫ সালে, এখন থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে। মধুপুরের রেকারেন্স পিরিয়ডও ৩৫০ বছর। কাজেই গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী এ দুটি ফাটলরেখায় আগামী ২২৫ থেকে ২৪০ বছরের মধ্যে বিধ্বংসী ভূমিকম্প (ক্যারেক্টারস্টিক আর্থকোয়েক) সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা কম।

তবুও ঝুঁকির কারণ আছে: 

গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, রেকারেন্স পিরিয়ডের মধ্যবর্তী প্রতি ২০ বছর পর পর এসব ফাটলরেখা থেকে ৭ মাত্রার কাছাকাছি পর্যন্ত ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। গবেষণার ভাষায় এগুলোকে বলা হয়েছে ওই ফাটলরেখাগুলোর ‘নন-ক্যারেক্টারস্টিক’ ভূমিকম্প।

ডাউকি এ ধরনের ভূমিকম্পের উৎসস্থল হলে সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চলের জন্য এবং মধুপুর উৎসস্থল হলে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও ঢাকার জন্য তা ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তবে জাতীয় গৃহনির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ভবন নির্মাণ করে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এই ধ্বংসের মাত্রা সীমিত রাখা সম্ভব বলে গবেষকেরা মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, একেকটি অঞ্চলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা সম্পর্কে জেনে-বুঝে সে অনুযায়ী ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ করলে এবং ভূমিকম্পের সময় ও পরের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হলে মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সীমিত রাখা সম্ভব। যদিও ব্লিডিং কোড মেনে ভবন তৈরি ও মানুষকে সচেতন করা কোনটিই গত প্রায় ২৩ বছর ধরে সেভাবে করা হয়নি এবং হচ্ছেও না। ফলে মানুষ যেন ভূমিকম্পে অবধারিত মৃত্যু জেনে পথ চলছে আতংকে। অথবা দূরবর্তী ভূমিকম্পের ঢেউয়ের ধাক্কায় যখন আমাদের ভবনগুলো দুলছে অথবা ফাটল দেখা দিচ্ছে তখন মরে যাবার আতংকে বারান্দা বা ছাদ থেকে, সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে হতাহত হচ্ছে। অন্য দিকে জাপানে ভূমিকম্প সহনশীল ভবন বানিয়ে জাপানিরা সুউচ্চ অ্ট্টালিকার মধ্যে বসেও নিরাপত্তাবোধ করছে। আমরা শিখবো আর কবে?

 
অন্যান্য ফাটলরেখায়ও ভূমিকম্প হতে পারে: 

ওপরে উল্লিখিত পাঁচটি বিপজ্জনক ফাটলরেখা ছাড়াও দেশের ভেতরে আরও কয়েকটি ফাটলরেখা আছে বলে অনেকে মনে করেন। এর একটি (মানিকগঞ্জ, মতান্তরে বগুড়া ফাটলরেখা) থেকে ১৮৮৫ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। ১৯১৮ সালে আরও বড় ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল শ্রীমঙ্গল। এ ছাড়া গঙ্গা (রাজশাহী) ও সীতাকুণ্ড ফাটলরেখারও অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেক ভূতত্ত্ববিদ মনে করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, মানিকগঞ্জ বা বগুড়া ফাটলরেখা যেটিকে বলা হয়, গবেষণায় দেখা গেছে, সেটি আসলে মধুপুর ফাটলরেখারই অংশ। একইভাবে শ্রীমঙ্গল ফাটলরেখা পিবিএফ-২-এর এবং সীতাকুণ্ড পিবিএফ-১-এর অংশ। আর গঙ্গা ফাটলরেখাটি বাংলাদেশের ভূ-সীমানায় সক্রিয় নয়।

পদ্মা-মেঘনা ও যমুনা নদীর মিলনস্থল চাঁদপুর অঞ্চলে নির্দিষ্ট কোনো ফাটলরেখার অবস্থান নির্ণিত না হলেও অঞ্চলটির ভূ-প্রকৃতি নাজুক বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ভূ-তত্ত্ববিদ। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (জিএসবি) সংশ্লিষ্ট গবেষক-কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মঝেমধ্যেই ৪ বা তার কিছু বেশি মাত্রার যে ভূমিকম্পগুলো হয়ে থাকে, সেগুলোর উৎস কিছু সাধারণ ফাটলরেখা (বেইজমেন্ট কন্ট্রোল ফল্ট)। এগুলোতে বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এমনকি বারবার হওয়া এসব ভূমিকম্প বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও নয়। কারণ, বিপজ্জনক ফাটলরেখা ছাড়া বিধ্বংসী ভূমিকম্প সৃষ্টির নজির নেই।

এই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল ও জিএসবির বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, বড় ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর মৃদু যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে এবং মাঝারি যেসব ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেগুলো মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এই প্রস্তুতি হতে হবে চার ধরনের। এক, মানসম্পন্ন ভবন নির্মাণ। দুই, ভূমিকম্প হলে করণীয় কী সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি। তিন, ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্য অর্জন। চার, জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ পুনঃ শক্তিশালী (রেট্রোফিটিং) করা, যাতে জরুরি প্রয়োজনের সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ প্রয়োজনীয় সাড়া দিতে পারে।

বিগত ২০০৯-১০ সালে সীমিত পরিসরে করা ‘ফল্ট মডেলিং’-এর গবেষণাটি আরও এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন সময়ের প্রেক্ষাপটেই। দেশের প্রধান প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ শহর-নগরের ঝুঁকি হ্রাসের কার্যক্রমও চালিয়ে যাওয়া জরুরি। কারণ, ফল্ট মডেলিংয়ের মাধ্যমেই কোনো অঞ্চল বা দেশের ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি (সাইসমিক স্ট্যাটাস) জানা যায়। আর তার ভিত্তিতে তৈরি করা দরকার নির্মাণ বিধিমালা।
সর্বোপরী ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসার পানি সরবরাহ লাইন এবং সুয়ারেজ লাইনের একটি যথাযথ ম্যাপিং প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে। এটি থাকতে ভূমিকম্পসহ যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভবপর হবে।

ইতিমধ্যেই ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু নীতিমালা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০১৫-২১, দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি-২০১৯, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২, দ্রুত পুনরুদ্ধার দিকনির্দেশনামূলক মূল নীতিমালাসমূহ। এ ছাড়াও ভূমিকম্পের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রণয়ন হয়েছে আর্থ কোয়েক কনটিনজেন্সি প্ল্যান-২০১৯। সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হচ্ছে দক্ষ স্বেচ্ছাসেবক দল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এ সব উদ্যোগই ব্যর্থ হবে যদি সঠক নগর পরিকল্পনা, উপযুক্ত উপায়ে স্থাপত্য নির্মাণ করা না হয়। পুরোনো ভবনগুলোকে রক্ষা করার সময় এটাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ একটি আপৎকালীন চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। সুতরাং এর রেট্রোফিটিং খুবই জরুরি। 

ঢাকা শহরের ঝুঁকি আসলে কতটা?

তুর্কির সাম্প্রতিক ভূমিকম্পকের পরে প্রায়শই শোনা যাচ্ছে, রিখটার স্কেলে ৬ বা ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ কিংবা অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বাড়িঘর ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। পাশাপাশি আরেকটি মত হলো, একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার তেমন কিছু হবে না। তবে ভূমিকম্পে ঢাকার ঝুঁকি আসলে কতটা, তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় নরম মাটিতে ও জলাশয় ভরাট করে তৈরি সুউচ্চ স্থাপনা ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ভূতাত্বিক গঠনের দিক থেকে ঢাকার  কাছাকছি কেন্দ্রস্থল না থাকায় ঢাকা শহর ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাছাড়া অতীতেও ঢাকায় কোনো বড় ভূমিকম্পের নজির নেই। তবে অপরিকল্পিতভাবে,বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন তৈরির মাধ্যমে এ শহরকে ঘিঞ্জি করে ফেলায় কিছুটা দূরবর্তী স্থানে ৬ থেকে ৭ মাত্রা্র ভূমিকম্পে ঘনবসতির ঢাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

অবশ্য ঢাকা শহরের ঝুঁকির বিষয়ে আমাদের বিশেজ্ঞরা তিন ধারায় বিভক্ত। একটি দল মনে করেন, যেকোনো সময় এই মহানগরী প্রবল ভূমিকম্পের কবলে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে বলে অহেতুক আতংক ছড়ানো হচ্ছে। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নীরব মধুপুর ফল্ট হঠাৎ জেগে উঠে প্রলয় ঘটাবে- এভাবনাও কল্পনাবিলাস ছাড়া কিছু নয়। কারণ এই ফল্ট এর সঠিক অস্থিত্ব আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

আরেক দল বলছে, ভূমিকম্পের একশ-দেড়শ বছরের একটি চক্র রয়েছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্পের ১২৪ বছর পেরিয়ে গেছে। অধুনা মাঝে মধ্যেই মৃদু ও মাঝারি ধরণের যে ভূমিকম্প হচ্ছে তা বড় ভূমিকম্পেরই পূর্বাভাস।

অন্য তৃতীয় দলের মতে, ভূমিকম্প একশ বছরের সাইকেল অনুসরণ করে না। এটি হল আসলে পরিখ্যানের ভাষা।সাইকেল তত্ত্ব মেনে নিলে একবার ভূমিকম্প হয়ে গেলে আমরা শ’খানেক বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তবে ১৮৯৭ সালের শিলং ভূমিকম্প হওয়ার আগের চারশ’ বছরের কোন রেকর্ড নেই কেন? তারা মনে করেন ভূমিকম্পের ঝুঁক সবসময়ই ছিল, এখনও আছে এবং সবসময়ই থাকবে। অবশ্য তারা মনে করেন মধুপুর ফল্ট সক্রিয় হলে বড় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে ঢাকায়।

জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (টিআইটি) সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক এবং দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান জনাব এ এস এম মাকসুদ কামাল ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে নিবিড় গবেষণা করেছেন। এই গবেষণায় তিনি শূন্য থেকে তোলা (এরিয়াল) ছবি, যুক্তরাষ্ট্রের নাসার ল্যান্ডসেড ও ভারতের আইআরএস স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে ঢাকার ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার মাটির প্রকারভেদ নির্ণয় করেছেন। এতে দেখা যায়, এখানে প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগের কঠিন মাটি (ঢাকার লাল মাটি, যার বৈজ্ঞানিক নাম প্লাইস্টোসিন ট্যারেস) যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নরম মাটিও। ওই ৩০৫ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১০৯ বর্গকিলোমিটার লাল মাটি। বাকিটা নানা শ্রেণির নরম মাটি। নরম মাটির মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ বা ৮৩ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে জলাশয় ভরাট করা নিচু জমি।

এসব মাটির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় ১৭ প্রকার মাটি রয়েছে। যেসব এলাকায় জলাশয় ও নিচু জমি ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব স্থানকে এর গভীরতা বা ঘনত্বের বিচারে মোট চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এরপর সর্বাধুনিক ‘মাইক্রো ট্রেমর’ যন্ত্র দিয়ে নগরের ১৮৪টি স্থান থেকে এবং ‘বোর হোল’ পদ্ধতিতে (যে পদ্ধতিতে বাড়িঘর বা অন্য কোনো স্থাপনা করতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে গর্ত করে মাটি পরীক্ষা করা হয়) ১৬৪টি স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ভূমিকম্পের সময় বিভিন্ন রকম মাটির আচরণ (রেসপন্স) নির্ণয় করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ঢাকার নরম মাটি এবং ভরাট করা এলাকার মাটি ভূমিকম্পের একটি নির্দিষ্ট মাত্রার কম্পন তরঙ্গকে অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়।

ভূবিজ্ঞান অনুযায়ী আমাদের পায়ের তলার মাটি ও মাটির ওপরে নির্মিত যেকোনো স্থাপনা একটি নির্দিষ্ট গতিতে সদা কম্পমান। একেক ধরনের মাটির কম্পন একেক রকম। কোনো একটি স্থানের মাটি এবং সেই মাটির ওপর নির্মিত স্থাপনার কম্পনের গতি ও মাত্রা যদি সমান হয়, তাহলে ভূমিকম্পের সময় ওই নির্দিষ্ট স্থাপনার কম্পনের মাত্রা ও সময় বেড়ে যায়। ফলে স্থাপনাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধসে পড়ে। আলোচ্য গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে, ঢাকার নরম মাটি ও ভরাট করা এলাকার মাটির কম্পন এবং এসব মাটির ওপর গড়ে তোলা ৯ থেকে ১৪ তলা উচ্চতার স্থাপনাগুলোর কম্পন সমান। এ জন্য এসব মাটিতে গড়ে ওঠা ওই উচ্চতার স্থাপনাগুলোর ভূমিকম্পে ঝুঁকি বেশি। একই সঙ্গে এসব জায়গার মাটি নরম হওয়ায় এই মাটি ভূমিকম্পের বিশেষ কম্পন তরঙ্গকে বাড়িয়ে দেয় বলে ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

এসব কারণের সঙ্গে অধিকাংশ স্থাপনার নিম্নমান ভূমিকম্পে ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব কারণেই বলা হয়, একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ব্যাপক ক্ষতি হবে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থা ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে পৃথিবীব্যাপী যে রেডিয়াস (রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনোসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনস্ট সাইসমিক ডিজাস্টার) জরিপ পরিচালনা করে, তার ফলাফল অনুযায়ী ভূমিকম্পে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ পৃথিবীর ২০টি বড় শহরের মধ্যে ঢাকা একটি। যদিও ২০০৭ সালে ফোরবস পরিচালিত জরিপে ভূমিকম্পে বিশ্বের ২০টি ঝুঁকি র্পর্ণ শহরের তালিকায় ঢাকা শহরের নাম নেই। মূলত এ শহরের দূর্বল অবকাঠামোগত অবস্থান, পরিকল্পনাহীন বাড়িঘর ও স্থাপনা নির্মাণই একে বেশি ঝুঁকিতে ফেলছে। তাই রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক উভয়স্তরেই সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই এর থেকে বাঁচার।

অন্যদিকে, ঢাকার এই ঝুঁকির কারণ যতটা না ভূতাত্ত্বিক, তার চেয়ে অনেক বেশি অবকাঠামোগত। এর জন্যে আমরা মানুষরাই দায়ী। মানুষই এই ঝুঁকি কমাতে পারে। এ জন্য বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাণ বিধিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা অপরিহার্য। ভূমিকম্পের সময় মানুষকে উদ্ধার করারও যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঢাকায় এগুলো একেবারেই করা হয় না। তাই ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি ঢাকার কোন এলাকার কোন ধরনের মাটিতে কত তলা পর্যন্ত স্থাপনা নির্মাণ নিরাপদ, তা জেনে সে অনুযায়ী নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়, তাহলে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার তেমন ক্ষতি হবে না। তবে ভূমিকম্পটি কোথায় হচ্ছে, উৎসস্থল কোথায়, তার ওপরও ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে।

এছাড়া জার্মান সরকারের কারিগরি সহায়তায় ঢাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন ও নির্মিত ভবন সম্পর্কে গবেষণা করে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি)। ঢাকার যেসব এলাকায় নিচু জমি ভরাট করে ভবন করা হয়েছে, তেমন কয়েকটি এলাকায় পরিচালিত ‘ঢাকা মহানগরীর বিল্ডিং গ্রাউন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম’ শীর্ষক এই গবেষণায় পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, নিচু জমি ও জলাশয় ভরাট করে তৈরি করা প্রায় সব ভবনের ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) মাটির অত্যন্ত দুর্বল উপরিস্তরে। ফলে মাঝারি মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা প্রবল।

১৯৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে সংঘটিত ভূমিকম্পের পর্যালোচনা ও অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা নেওয়া দরকার। সানফ্রান্সিসকোর এ ভূমিকম্প ‘লোমা প্রিয়েটা’ ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এতে ৬৩ জনের প্রাণহানি হয়, ৩৮০০ লোক আহত হয় এবং আনুমানিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬.৯ এবং স্থায়িত্ব ছিল ১৫ সেকেন্ড। সানফ্রান্সিসকোর মারিয়ানা ডিস্ট্রিক্ট সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ এর বিল্ডিং, মহাসড়ক ও ফ্লাইওভারগুলো তৈরি হয়েছে কাদামাটি দিয়ে খাদ ভরাট করে। এ ছাড়াও সান্তাক্রুজের অনেক ইট-বালুর বিল্ডিং ৫০ থেকে ১০০ বছরের পুরোনো হওয়ায় তা সম্পূর্ণ ভেঙে যায়।
১৯৮৯ সালে সানফ্রান্সিসকো-ওকল্যান্ডে সংঘটিত ভূমিকম্পে ফ্রিওয়ের উপরের তলা নিচতলার ওপর ভেঙে পড়ে অনেকে হতাহত হয়। এর প্রধান কারণ হলো এ ফ্রিওয়ের অংশটুকু মাডফিলের উপর তৈরি হয়েছিল। ফ্রিওয়ের এ অংশটুকুতে প্রয়োজনীয় রিইনফোর্সমেন্ট করার কারিগরি ভুলের খেসারত দিতে হয় অকারণ প্রাণহানির মধ্য দিয়ে।

সানফ্রান্সিসকোতে সংঘটিত এ ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিলে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব যে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি-যদি আমরা আমাদের ভবনগুলো মাডফিলের উপর কোনো ধরনের রিইনফোর্সমেন্ট ছাড়া শুধু ইট-বালুতে তৈরি করি। এ হিসাবে ধারণা করা যায়, ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্পে আমাদের রাজধানীর পুরান ঢাকার সব পুরোনো ভবনসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় এ ধরনের স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে এবং অগণিত প্রাণহানি, আহত ও সম্পদের ক্ষতিসাধন হবে।

একই চিত্র প্রতিবার, আতংকিত করা হচ্ছে মানুষকে

প্রতিবারই বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার পরপরই নানান  তৎপরতা দেখা যায় বাংলাদেশে, যা ধামাচাপা পড়ে থাকে বড় ধরনের আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আগ পর্যন্ত। ২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। সে সময় জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করার। সেই সিদ্ধান্তটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছিল। এটিও আলোর মুখ দেখেনি এখনও। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ এবং সচেতনতা এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী সম্প্রতি বলেছেন, গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্প অনেক বেড়েছে। আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। এটা আতঙ্কের বিষয়, তার মানে ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ৮ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে রাজধানীর প্রায় ২৫ ভাগ ভবনই ধসে পড়বে। তুর্কিতে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। অধ্যাপক আনসারী বলেন, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবনধসে। দ্রুত দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সবকটিকে ভূমিকম্প-সহনশীল করতে হবে। সারা দেশে বড় বড় শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্পন সহনীয় কিনা, সেটা যাচাই করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহফুজুল হকও সম্প্রতি বলেছেন যে, গত দুই দশকে ঢাকার নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের যেসব এলাকায় নগরায়ণ হয়েছে, সেসব এলাকার মাটির বৈশিষ্ট্য ও ভূতাত্ত্বিক গঠন নগরায়ণের উপযোগী নয়। ফলে ভূমিকম্প হলে বছিলার এলাকায় দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা অনেক বেশি। ঢাকার ভূমিতলের উচ্চতা ৫ থেকে ১৮ মিটারের মধ্যে। যথাযথভাবে ‘ভূমি উপযোগিতা বিশ্লেষণ’ না করে বর্তমানে নগরায়ণ হওয়াতে সামনের দিনগুলোতে নগর দুর্যোগের শঙ্কা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভূতত্ত্ববিদ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলে ঢাকায় জলাভূমি ভরাট করে নির্মিত ভবনগুলো ভেঙে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে। শহরের অপরিকল্পিত ভবন ও সরু সড়কের কারণে ফায়ার সার্ভিস এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হবে। তা ছাড়া ভূমিকম্পের সময় খোলা জায়গা না থাকা, মাঠ বা উদ্যান না থাকার কারণে ভবন ছেড়ে বের হয়েও দুর্ঘটনার হুমকিতে থাকবে মানুষ। পরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণের দিকে ফিরে যাওয়াই হচ্ছে আগাম সতর্ক ব্যবস্থা। সেদিকেই জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস, ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের পর দেশের উপকূলীয় এলাকায় সুনামির আশঙ্কা থাকে। তাই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও হাসপাতালগুলোকে আধুনিক করতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, ভূমিকম্পসহ যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের সব বাহিনী প্রস্তুত আছে। আধুনিক ওয়্যারলেস কেনা হয়েছে। প্রায় ৬০ হাজারের বেশি ভলান্টিয়ার রয়েছে ভূমিকম্পের সময় কাজ করার জন্য। বছরে দুবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মহড়া কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মানুষও আগের চেয়ে সচেতন। তিনি বলেন, ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণে নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা করা হয়েছে। এটি মানা হলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে।

ভূমিকম্পের ১০০ বছরের ধারণা যেসব বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন তারা কিন্তু একটা আতংক চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে বিগত ২০০৯-১০ সালে সীমিত পরিসরে করা ‘ফল্ট মডেলিং’-এর গবেষণাটি যারা করেছিলেন,তারাই তখন বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরের সন্নিহিত অঞ্চলে অনেকগুলো ফাটলরেখা থাকলেও নিকট ভবিষ্যতে সেগুলো বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্পের উৎসস্থল (এপিসেন্টার) হওয়ার আশঙ্কা কম। এখন তারাই আবার অন্য কথা বলছেন বলে মনে হচ্ছে। সরকারি এবং বিদেশী দাতা সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তায় করা এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। অথচ মাত্র সাত-আট বছর যেতে না যেতেই বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞরা অন্য ভাষায় কথা বলছেন এটি কিসের আলামত? সচেতন জনগণ মাত্রই জানতে চায় বিগত দিনের এসব গবেষণালব্ধ তথ্য কাজে লাগিয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ আর্তকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব ড. আলী আকবর মল্লিক ২০১৬ সালের দিকে একবার বলে ছিলেন যে, ‘বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ তাই ভূমিকম্প সহনশীল ভবনে বাস করাও অপরিহার্য। সঙ্গে সঙ্গে এটিও বলা যায় যে, ভূমিকম্পে কারণে আতংকিত হবার কিছু নেই, কারণ খুব বড় ঝাঁকুনিতে এ দেশ আক্রান্ত হবার আশংকা কম।’
প্রশ্ন হলো, এত্সব স্ববিরোধী কথায় সাধারণ মানুষ আতংকিত হবে না সচেতন হবে তা ভেবে দেখার সময় কি এখনও আসেনি? 

বাংলাদেশে ১৯৫০ সালের আগস্ট মাসে ৮.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যার এপি সেন্টার ছিল ভারতের আসাম রাজ্যে। এই ভূমিকম্প সারা বাংলাদেশে অনুভূত হলেও কোন ক্ষয়ক্ষতির রেকর্ড পাওয়া যায়নি।(হিসট্রি অব আর্থওয়েক ইন্সিডেন্স ইন বাংলাদেশ, আলী এবং চৌধুরী, ২০০৯)। এধরণের ভূমিকস্পকে বলা হয় ক্যারেক্টারস্টিক ভূমিকম্প। এরপর থেকে বাংলাদেশের আশপাশে সীমান্ত বরাবর বা দেশের ভিতর থেকে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে তার প্রায় সবই ‘নন- ক্যারেক্টারস্টিক’ ভূমিকম্প। প্লেট বাউন্ডারিতে সর্বশেষ ৮.৪ মাত্রা্র ভূমিকম্প হয়েছিল ১৯৫০ সালে।এখন একশ বছরের সাইকেল মেনে নিলেও পুনরায় এখান থেকে ভূমিকম্প এর ঝুঁকির প্রায় ৭৩ বছর বাকি। 

আবার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকম্প নিয়ে বিগত দুই যুগ ধরে যে গবেষণা করেছে, সেখানে দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোনো ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে।  ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। 
ভূতত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, এটা যেমন একবারে হতে পারে, আবার কয়েকবারেও হতে পারে। তবে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে সাত বা আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। কিন্তু কবে বা কখন সেটা হবে, তা এখনও বিজ্ঞানীদের ধারণা নেই। খোদ বিজ্ঞানও এখন পর্যন্ত পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানে চুড়ান্ত কোন মতামত নেই। সবই অনুমিত।

এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ববিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ জাপান, ইরান বা আসামের মতো খুব একটা ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা নয় তবে বাংলাদেশে ছোট-বড় অসংখ্য ভূমিকম্প হয়েছে।ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা আছে-যেহেতু বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির কাছাকাছি অবস্থান করছে। তবে বাংলাদেশে পলিমাটির দেশ বলে একটা সুবিধা হচ্ছে ভূমিকম্প হলে তেমন ব্যাপক আকার ধারণ করে না। কারণ পলিমাটির কারণ ধ্বংসজ্ঞটা কম হয়। তিনি আরো বলেছিলেন, কোন প্লেট বাউন্ডারি এলাকায় যদি শতাধিক বছর ধরে বড় ধরনের কোন ভূমিকম্প না হয় তখন বৈজ্ঞানিকরা বা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন একটা প্রচণ্ড ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু যদি ছোট ছোট ভূমিকম্প হয় মাঝে মাঝে, (যেটা আমাদের দেশে দেখা যায়।)তাহলে প্রলয়ংকরি ভূমিকম্প হয়তো হবে না। কারণ ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্প হবার শক্তিকে খানিকতা হলেও রিলিজ করে দেয়।

সচেতনতা সৃষ্টি ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে

তবে একটা জরুরি প্রস্তুতির কথা আমাদের বিশেষজ্ঞরা আগেও বলে এসেছেন, এখনও বলছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, তাই দৃশ্যমান প্রস্ততি এখনও দেখা যাচ্ছে না।বরং একটা আতংক ছড়ানো হচ্ছে এমনটি বলে যে, ফ্লাইওভার সব ভেঙ্গে পড়বে, ঢাকা হবে কংক্রিটের নগরী, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। আদতেই দেশের মানুষকে তথা ঢাকাবাসীকে ভূমিকম্প সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত করা হচ্ছে না। কারণ সচেতনতাই অনেক বড় বিপদ থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে। আমারদের প্রশ্ন ঢাকার মাটি যদি এতোই নাজুক হয় তাহলে কেন এই শহরে মেট্রোরেল, পাতাল রেল করা হচ্ছে? পাতাল রেলের বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পুরো অংশ হবে ভূগর্ভে। অথচ এই এলাকা ভূমিকম্পপ্রবণ বেশি। তাছাড়া মাটির নীচে যখন বরিং করে মাটি উত্তোলন করা হবে তখন আশপাশের স্থাপনাগুলোও দুর্বল হয়ে যাবে। তাই এই ‘আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল’ প্রকল্প ঢাকা শহরের জন্য কতটা উপযোগী বা টেকসই হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি এ বিষয়গুলো আগেই যাচাই করা হয়েছে।

ভূতাত্বিক জরিপেই জানা গিয়েছে যে, ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকা ভূমিকম্প নাজুক। এর মধ্যে ঢাকার পূর্বাচল, রামপুরা, বেগুনবাড়ি, বাসাবো, পাগলা খালের দক্ষিণ দিক, দক্ষিণ দিক, তুরাগ নদী ও বাউনিয়া খালের পশ্চিমাঞ্চল রয়েছে। পাতাল রেল বানানোতে এসব বিষয় বিবেচনা নেওয়া অবশ্যই উচিত। 

ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজধানীই নয়, এই মহানগর বাংলাদেশের প্রাণ। তাই সেই প্রাণকে বাঁচানোর সময় এখনও হয়তো আছে। ঢাকায় বড় বড় স্থাপনা ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়লে কেবল ব্যাপক প্রাণ হানিই হবে না, পুরো দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোই চুরমার হয়ে যাবে। তাই দ্রুত দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সবক'টিকে ভূমিকম্প-সহনশীল করতে হবে৷ আর সেটি করার মতো কারিগরি দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে৷ তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার৷ সারা দেশে বড় বড় শহরে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্পন-সহনীয় কিনা, সেটা যাচাই করতে হবে৷ কোনো বাসা খারাপ থাকলে মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ কারণ, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবন ধসে৷ 

তাই অযথা বিশেষজ্ঞ এবং মিডিয়া মিলে আতংক তৈরি করলে হবে না। সচেতনতা ও সতর্কতা বাড়াতে হবে।যা বাস্তব। যা আমাদের হাতে রয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে। সরকার ও জনগণের স্বদিচ্ছা থাকলে খুব দ্রুত সময়ে তা বাস্তবায়নযোগ্য। আর তা হচ্ছে ঢাকা শহরের বিকেন্দ্রিকরন।ঢাকার লোক সংখ্যা কমিয়ে আনা। দুর্বল ভবন চিহ্নিত করে তা রেট্রোফিটিং করা। নতুন ভবন বানাতোতে ব্লিডিং কোড মেনে চলা ও বাস্তবায়ন করা। কারণ ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন বানানোতে মাত্র তিন শতাংশ বেশি খরচ করতে হবে।আর তাতে ভূমিকম্পে তা ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকিও কমবে। এছাড়াও কতগুলো কাজ সরকারকে অবশ্যই করতে হবে যা সুপারিশ আকারে নিম্নরূপ হতে পারে: 

•	জনসচেতনতা বৃদ্ধি,  ভূমিকম্প মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি , ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্গঠন কর্মসূচি।
•	ব্লিডিং কোড যথাযথভাবে বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং ও আইন প্রণয়ন এবং তার দ্রুত প্রয়োগ।
•	দেশের নাগরিকদের পরিস্থিতি মোকাবিলায় মহড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাঝেমধ্যে এমন মহড়া দিলে মোকাবিলা করার সাহস তৈরি হবে। আমাদের বাড়ি-ঘর হয়তো নিয়ম মেনে তৈরি হয় না। কিন্তু এই দুর্বল অবকাঠামোর বাড়িঘরেও কীভাবে আসবাব অথবা ভবনের কোন অংশে আশ্রয় নিয়ে শরীরের কোন বিশেষ অঙ্গ আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করলে অন্তত জীবন বাঁচানো যাবে, এ বিষয়ে সচেতনতা ও প্রচারণা বাড়াতে কাজ করতে হবে পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে।

•	ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মাটির নিচে থাকা গ্যাস ও বৈদ্যুতিক লাইনগুলোকে অটো শাটডাউন করার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে ভূমিকম্পের পরে ক্ষয়ক্ষতি অনেক ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ঢাকায় বেশিরভাগ ভবনই তৈরি হয়েছে জলাভূমি ভরাট করে। যেখানে মাটির সক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলেও এগুলো ভেঙে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে। বলতে গেলে ভবন নির্মাণ বিধিমালা না মানার কারণে সব বিভাগীয় শহরই ঝুঁকিতে আছে। ভূমিকম্পের পর এগুলো থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। শহরের সব অপরিকল্পিত ভবন ও সরু সড়কের কারণে ফায়ার সার্ভিস এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হবে। তা ছাড়া ভূমিকম্পের সময় খোলা জায়গা না থাকা, মাঠ বা উদ্যান না থাকার কারণে ভবন ছেড়ে বের হয়েও দুর্ঘটনার হুমকিতে থাকবে মানুষ। পরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণের দিকে ফিরে যাওয়াই হচ্ছে আগাম সতর্ক ব্যবস্থা। সেদিকেই জোর দিতে হবে।

•	ফায়ার সার্ভিস, ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।  সরকার কিছু কাজ হাতে নিয়েছে, বাদবাকি কাজও সম্পন্ন করতে হবে।পাশাপাশি বিদ্যমান স্ব্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে।  নতুন স্ব্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের পর দেশের উপকূলীয় এলাকায় সুনামির আশঙ্কা থাকে। তাই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও হাসপাতালগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে।

নদী জলাশয় ভরাট ও দখল, জলপ্রবাহে বাধা-ব্যারেজ নির্মাণ ইত্যাদি ভূমিকম্পের অন্যতম প্রধান অনুঘটক বলে দেশ-বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন। কারণ মাটির নীচে পানিস্তর পরিমাণ মতো থাকলে ভূমিকম্প সৃষ্ট ওয়েভ বেশি বিস্তৃত হতে পারে না এবং ক্রমশ তা দুর্বল হয়ে যায়। 

সমুদ্র-নদী-জলাশয় বেষ্টিত বাংলাদেশ মূলত একারনেই বারবার রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।কিন্তু নদী-জলাশয়-পুকুর দখলকারীরা সেই প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বলয়কে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে।বাংলাদেশে এখন আস্তে আস্তে সেই বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।বাড়ছে ভূমিকম্পজনিত মারাত্নক নিরাপত্তা ঝুঁকি যা অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ভয়াবহ হতে পারে। 

অবকাঠামোগত যথাযথ উন্নয়ন না হওয়ায় গ্যাস-বিদ্যুৎজনিত বিস্ফোরণে এখনই বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত আর একটি ভূমিকম্পকালীন সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানী এবং সম্পদ ভূমিকম্পে যতটা নয় তারও চেয়ে বেশি আগুন লেগে ও বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে!তাই এখনই সময়। বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় ঘোষণা দিয়ে, সংসদে আইন পাশ করে এবং এসব পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কাজ বন্ধে সর্ব্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারিত করে কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা ও ভয়াবহ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই এখন আমাদের অস্থিত্বের জন্য সর্বোত্তম উপায় হতে পারে।

পাঠকের মন্তব্য


একই ধরনের লেখা, আপনার পছন্দ হতে পারে

bdjogajog