সাম্প্রতিক প্রকাশনা

নববর্ষে প্রথম প্রহরে উৎসবের নামে উন্মাদনা কি বন্ধ হবে না?

আলতামাস পাশা লেখাটি পড়েছেন 1226 জন পাঠক।
 নববর্ষের উৎসবের নামে উন্মাদনা কি বন্ধ হবে না? ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল এবার ৩১ ডিসেম্বর রাতে খ্রীস্টিয় নববর্ষ উদযাপনকালে নগরীর কোথাও কোনো ধরনের আতশবাজি বা পটকা ফোটানো এবং ফানুস উড়ানো যাবেনা। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টো চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে। প্রায় টানা ৪/৫ ঘন্টা ব্যাপী আতশবাজি বা পটকা ফোটানো এবং ফানুস উড়ানোতে ব্যস্ত ছিল কিছু উৎশৃঙ্খল তরুণ। কেউ তাদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি বা চেষ্টা করেনি। ঢাকা শহরের বেশ কিছু স্থানে ফানুস থেকে আগুনও লাগে। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ছিল ঢাকার মেট্রোরেলে বৈদ্যুত্যিক তারের ফানুস এসে আটকে যাওয়াতে প্রায় দু’ঘন্টা এই স্থাপনা নিরাপত্তার জন্য বন্ধ রাখা হয়। পরে ফানুস অপসারিত হলে তা আবার চালু হয়। দেশের এই কেপিআই স্থাপনায় যদি ফানুস থেকে কোনো ভাবে আগুন লাগতো তা’হলে সে দায়ভার কে বহন করতো? 

আজ জাতির সামনে প্রশ্ন হলো কেনো আমারা এসব উৎশৃঙ্খল তরুণকে বিজাতীয় উৎসব আনন্দ থেকে বিরত রাখতে পারছি না। পুলিশের কি দায়িত্ব ছিল না এসব আতশবাজি বা পটকা ও ফানুস যারা বিক্রি করেন তাদের বিক্রি বন্ধ করা। কিন্তু এক্ষেত্রে যথাযত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র নির্দেশনা দিয়ে বাসাবাড়ির ছাদ থেকে আতশবাজি বা পটকা ফাটানো বা ফানুস উড়ানো বন্ধ করা কি সম্ভবপর?

যেকোনো উৎসব আপনি পালন করতেই পারেন। কিন্তু আপনার নিজের আনন্দ যদি অন্যের বিরক্তির বা আতংকের কারণ হয় তা’হলে তা অবশ্যই বর্জনীয়। আতশবাজি বা পটকা ফোটানো শিশু বা দুর্বল চিত্র মানুষের মধ্যে প্যানিক অ্যাটাকের সূত্রপাত করে। হার্টের রোগীও প্রচন্ড শব্দে আতশবাজি বা পটকার বিস্ফোরণে আতংকগ্রস্থ হয়ে মারা যেতে পারেন।

ইউনিসেফ বলছে প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে,  ‘ভীতি ও উদ্বেগের অনুভূতি যা হঠাৎ করেই আমাদের হতবিহ্বল করে দিতে পারে এবং সাধারণত এর সঙ্গে হালকা মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার মতো তীব্র শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক শিশু আতঙ্কঅনুভব করে, যেমন সে মনে করতে পারে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। এমনকি যখন প্রকৃতপক্ষে কোনো বিপদ থাকে না, তখনও এই অনুভূতি হতে পারে’।

এই প্যানিক অ্যাটাকের কারণেই গত বছর শিশু উমায়ের মারা গিয়েছিল। তার চিকিৎসা চলছিল মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। মায়ের পেট থেকেই সে হৃদপিÐে ছিদ্রসহ জন্ম নিয়েছিল। চিকিৎসাও চলছিলো। কিন্তু চারপাশের প্রতিকূল পরিবেশ তাকে অস্ত্রপ্রচার পর্যন্ত আর বেঁচে থাকতে দিল না। ঢাকা শহরব্যাপী আতশবাজি, পটকা ফাটানো প্রচÐ শব্দে ভীত হয়ে প্যানিক ডিজ অর্ডারে সে মারা গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের উন্মদনায় কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আমাদের তরুণ সমাজ সারা ঢাকা শহরব্যাপী আতশবাজি, পটকা ফাটানো ও ফানুস উড়ানোর যে বাঁদর নাচ নাচে তা’কি আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত? বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে এই উন্মুক্ত উদযাপন কী কোনোভাবে খাপ খায়? এই উদযাপন যেমন পরিবেশের ক্ষতি করেছে, তেমনি ঢাকা শহরে বসবাসরত বিভিন্ন পাখিদের জীবনাচরনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শালিক চড়ুই, কাক, আবাবিল, পায়রা সহ বিভিন্ন প্রকার পাখি আতশবাজির প্রচন্ড শব্দে দিশেহারা হয়ে এদিক সেদিক ছুটে বেরিয়েছে উন্নয়নের আলোকে আলোকিত এই মহানগরে। উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, নববর্ষ উদযাপনের এই উন্মদনা শুধুমাত্র শহর এলাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই তা আজ গ্রামেগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে নির্জন গ্রামও আজ ইংরেজিতে নববর্ষের প্রথম প্রহরে আতশবাজি বা পটকা এবং ফানুসের আলোতে আলোকিত হচ্ছে। এধরনের বিজাতীয় আনন্দ থেকে আমরা কি বেরিয়ে আসতে পারবো?

আমাদের ছোটবেলায় ইংরেজি নববর্ষের উৎসব আমরাও করেছি। কিন্তু বর্তমানের আতশবাজি এবং ফানুস উড়ারো ও পটকা ফাটিয়ে থার্টি ফাস্ট নাইট আমরা কখনই পালন করিনি। এটা আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে যায় না। আর তা পালন করিনি বলে আমরা আনন্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হইনি। নতুন বছরের প্রথমদিনে আমরা পরস্পরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। পরিবারের মধ্যে নানান খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে সামর্থ অনুসারে।

উৎসব, আনন্দ অন্যকে যেন কষ্ট না দেয়, অন্যের মাঝে যেন বিরক্তির সৃষ্টি না করে সে বিষয়টিকে সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এই ঢাকা শহরে শুধু মানুষ থাকে না। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পাখি, কুকুর, বিড়াল, বেজি, বানর ইত্যাদি। ঢাকা শহরের তথাকথিত নগরায়ন এর পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। কাচ আর স্টিলের অবকাঠামোয় সূউচ্চ অট্টালিকাসমূহ শহরকে পরিণত করছে জ¦লন্ত অগ্নিকুন্ডে। শহরের তাপমাত্রা কমছে না। প্রতিদিন কাচ আর স্টিলের বহুতল ভবন সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে ছড়িয়ে দিচ্ছে আরও বেশি তাপ। ভবনগুলোর ভিতরে চলছে সারাদিনব্যাপী সেন্ট্রাল এয়ালকুলার। বাড়ছে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ। ঢাকা পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরে। এর মধ্যে বিগত ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টায় নববর্ষ পালনে আতশবাজি আর ফানুস উড়ানো উৎসব শহরের প্রায় ১০টি স্থানে অগ্নিকাÐসহ ঢাকার বাতাসকে করেছে আরো দূষিত।

আমাদের দেশে বহু পরিবেশবাদী সংগঠন রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে তাদের চিন্তার, উৎকণ্ঠার কোনো শেষ নেই। অথচ বিগত কয়েক বছরব্যাপী ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে প্রায় সারা রাতব্যাপী ঢাকা শহরজুড়ে আতশবাজী, বোমাবাজী ফানুস উড়ানোর যে মহোৎসব চলে সে ব্যাপারে তারা নির্লিপ্ত রয়েছেন। শহরের রাস্তার কুকুরপ্রেমী মানুষগুলোও ভাবেন না পাখিদের কথা, মা কোলে আতশবাজীর শব্দে কেঁপে উঠা শিশুটির কথা অথবা হার্টেও রোগী প্রবীণ মানুষদেও কথা। যারা বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকারের প্রশ্নে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন তারাও এবিষয়ে নিরব থাকেন বছরের পর বছর।

ভোগবাদী উৎসবের উপকরণ এসব আতশবাজী, পটকা- বোমা ও ফানুস শুধুমাত্র আজ রাজধানী ঢাকাই নয়, ছড়িয়ে গেছে গ্রাম-গঞ্জের ছোট ছোট টং দোকানেও। চীন থেকে আমদানী হওয়া এসব ক্ষতিকর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১০ টাকায়। ছোট শিশুরাও এগুলো নিজেরা কিনে প্রচন্ড শব্দে ফাটাচ্ছে। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় কোন দুর্ঘটনা। অথচ অনেক অভিভাবকই এসব কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। ঘৃণা আসে তাদের প্রতি যারা ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে জানান, “আমাদের উৎসবগুলো ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।” কারণ ঢাকা শহরের কতিপয় স্থান পুলিশ বিধিনিষেধ আরোপ করে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে, এতে উক্ত সুশীল সমাজের মানুষ খুবই নাখোস হয়েছেন। কিন্তু দুঃখ এখানেই যে আতশবাজী, বোমাবাজী ফানুস উড়ানোর যে মহোৎসব চলে তা বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেন না। যে উৎসব আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না, বাঙালি চেতনার সঙ্গে যায় না, ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না, সে উৎসব যদি ছিনতাইও হয় আজ তবে তা দোষের কি? 

এখনও হয়তো সময় আছে ঘরের ছেলেদের ঘরে ফেরার। সংযমী আচরণ করার । সেই সাথে এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে। সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সামনে পবিত্র শবে-বরাত আসছে। শবে-বরাতে পবিত্র রাতেও এক শ্রেণীর মানুষ আতশবাজী, বোমাবাজীর মহোৎসব করে। এ বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপরতা আরো জোরদার করতে হবে। এতে পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে, মানুষের মনেও প্রশান্তি আসবে। আমাদের সবাইকে এখনই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্লিপ্তভাবে ঘরে বসে থাকার সময় আর নেই। কারণ আমাদের গ্রামগুলোও আজ আক্রান্ত হচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপে।

পাঠকের মন্তব্য


একই ধরনের লেখা, আপনার পছন্দ হতে পারে

bdjogajog