তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ওঝি মান্ডার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে আশংকার ভাব। চোখ দুটি যেন ফেটে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র হতাশ হননি। অকস্মাৎ তার চোখে পড়লো, সামনেই মুহ্যমানের মতো বসে আছেন মিনহাজ সাহেব, দু’হাতে মাথা চেপে ধরে। একটা কম্বলের ওপর শুয়ে রয়েছে সেলিম। শরীরটাও তার আরেকটা কম্বলে ঢাকা। কাছে গিয়ে ওঝি মান্ডা দেখতে পেলেন কম্বল নয় আলট্রা থিন মহাজাগতিক রশ্নি প্রতিরোধক তন্তু দিয়ে সেলিমকে ঢেকে রাখা হয়েছে।
- মিনহাজ সাহেব- ওঝি মান্ডা ধীর কন্ঠে ডাকলেন। কিন্তু মিনহাজ সাহেব ওঝি মা-ার আবির্ভাব সত্ত্বেও কোনো কথা বললেন না, মুখ তুলেও চাইলেই না। শুধু ব্যথা কাতর মুখে বললেন,
- ওঝি মান্ডা! বড্ডো দেরি হয়ে গেছে। সেলিমকে আর বুঝি বাঁচানো গেল না। ও ক্যাম্প থেকে চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলো- বাধ্য হয়ে আমি তাকে আঘাত করেছি, তাই জ্ঞান হাড়িয়ে পড়ে আছে। অন্যরা অদৃশ্য আলোর টানে ছুটে বেরিয়ে গেছে চিৎকার করতে করতে আর ফিরে আসেনি। তবে আঘাত জর্জরিত সেলিম এখানেই পড়ে আছে। প্রাণ আছে কি নেই জানি নে।
মিনহাজ সাহেবের মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। আচমকা উঠে বসলো সেলিম মাথায় আঘাতের স্থানে হাত বুলাতে বুলাতে। চোখ বিস্ফোরিত করে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন মিনহাজ সাহেব। ওঝি মান্ডা বলে ওঠেন মনে রাখতে হবে আমরা কোনো
মহাজাগতিক শক্তির বিপক্ষে লড়াই করছি। অতত্রব সাবধান। যদিও তাংতিয়াং হরিণ বলি দিয়েছে- কথাটা বলেই মৃদু হেসে তিনি মিনহাজ সাহেবের দিকে তাকান।
- মিনহাজ সাহেব উত্তর দেন ব্যাপারটি কিন্তু মোটেই হাসির বিষয় নয় ওঝি মান্ডা। আদিবাসীরা অনেক কিছু করে যা দেখে আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভট মনে হলেও এর পেছনে কারণ একটা থাকেই।
আর তাংতিয়াং না জেনে না বুঝে কিছু করছে বলে আমার মনে হয় না।
ওঝি মান্ডা তার সাথে এনেছেন আলট্রা সাউন্ড প্রুফ হেলমেট ও মহাজাগতিক রশ্নি প্রতিরোধক স্পেশ স্যুট। দ্রুত মিনহাজ সাহেব এবং সেলিম তা পরে ফেললেন। ভালকান থেকে পাঠানো লেসার বেটা গান এখন শোভা পাচ্ছে মিনহাজ সাহেব আর সেলিমের হাতে। সেলিমের নতুন প্রাণসঞ্চার হয়েছে। সে এবার গুণগুণিয়ে গানও গেয়ে ওঠে। বহুদিন পর তার মুখে উনিশ শতকের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই,’ আমার সোনার হরিণ চাই গানটি গীত হয়ে থাকে।
ভালকানবাসী ওঝিমান্ডা বলে ওঠেন, সেলিম ভায়া, তাংতিয়াং কিন্তু হরিণ বলি দিয়েছে। তুমি এখন সোনার হরিণ কোথায় পেলে? সেলিম সে কথার জবাব না দিয়ে বলে ওঠে, ওঝিমান্ডা আপনাদের ভালকানে কি হরিণ আছে? আচ্ছা ওঝিমান্ডা আমাকে ভালকানে নিয়ে যাবেন?
- সে নেবো খ’ন। আপাতত চল তো এই কোয়ান্টাম লেসার বেরিয়ারগুলো ক্যাম্পের চার পাশে স্থাপন করে ফেলি। রাত গভীর হতে বেশি দেরী নেই।
লেসার বেরিয়ারগুলো যথাস্থানে বসাবার কাজ শেষ হল। সেলিম ও মিনহাজ সাহেব বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলেন। তাদের ক্লান্তি দূর করতে ওঝিমান্ডা ভালকানের ক্লান্তি নিরোধক পানীয় পান করতে দিলেন। সে পানীয় পানের কয়েক মিনিটের মধ্যে বাপ-ব্যাটা তাদের সারা দেহে সতেজ অনুভূতি আবার ফিলে পেলেন। ওঝিমান্ডার দিকে ফিওে সেলিম প্রশ্ন করে, কী ছিল এই পানীয়তে?
- ওঝিমান্ডা মৃদু হাসলেন। কোনো উত্তর দিলেন না।
সেলিম রাতের খাবারের ব্যবস্থায় লেগে পড়ে। মেক্্িরকান হাঁসের ভুনা মাংস, তন্দুরে সেঁকা রুটি আর জলপাইয়ের আচার। চমৎকার হল রাতের খাওয়া। খাওয়া শেষে ওঝিমান্ডা ওদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন ভালকানের লামান্ডা ফলের রসের সুস্বাদু পানীয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ছুটি কাটাতে বন্ধুর কাছে এসেছে জোসেফ। ছেলেবেলায় বন্ধু নাহিদ কাজ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়। এখানে টংকাবতীতে বিশাল একটি রেডিও টেলিস্কোপ রয়েছে। এর মাধ্যমে মহাশূন্যে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্রের থেকে পাঠানো রেডিও টেলিস্কোপিক সিগন্যাল গ্রহণ করা হয় এবং বিশ্লেষণ করে দেখা হয় প্রাকৃতিক বেতার তরঙ্গ ছাড়াও অন্য বেতার তরঙ্গ এসে পৌঁছায় কিনা। অর্থাৎ মহাশূণ্যে বুদ্ধিমান প্রাণের অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। মূল অবজারভেটরি ছোট পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। ছোট একটি শহর এখানে গড়ে উঠেছে। রয়েছে সুপার রেল স্টেশন। ইন্টার ওয়ার্ল্ড পোস্ট অফিস। ছোট ছোট বাড়িঘরগুলো এখানে ভীষণ সুন্দর। এখানে আসা অবধি জোসেফের ভালোই লাগছে। টংকাবতীতে প্রতিটি সকাল অদ্ভুত সুন্দর। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে চর্তুদিক থেকে পাখি ডেকে ওঠে। এখানে এসে জোসেফ দেেেখছে তিতির, টিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, টুনটুনি, মৌটুসীসহ আরও কত জাতের পাখি।
সেদিন প্রাতঃকৃত্য সেওে জোসেফ আর নাহিদ বসেছে অবজারভেটরি সংলগ্ন লনে। সকালে চা ওখানেই দিয়ে গেছে বেয়ারা। চা পান করতে করতে জোসেফ বলে তোর কাজটি মূলত রাতের বেলাতেই?
- রাতের বেলা মানে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা। তারপর খেয়ে দেয়ে দিব্বি জম্পেস ঘুম দেই একটা। তবে দিনে অফিস করি মূলত লেখালিখির কাজের জন্য। বিভিন্ন রেডিও সিগন্যাল ডিকোডিং করি, রির্পোট লিখি। এই সব নানান কাজ আর কি।
আজ ভাবছি তোর সঙ্গে যাবো। দুটো সন্ধ্যা তো একা একাই কাটালাম- জোসেফ বলে।
বেশ তো। তুই গেলে মজা করা যাবে। একা একা আমিও ভীষণ হাঁফিয়ে উঠি।
সন্ধ্যাবেলা জোসেফ আর নাহিদ কফি খেতে খেতে কলেজ জীবনের স্মুতিচারণ করছিলো। অ্যাস্ট্রো ফিজিক্্েরর রব্বানী স্যারকে কিভাবে কোকের বদলে ল্যাম্বাসাবা খাইয়ে বোকা বানানো হয়েছিলো সে আলোচনা যখন তুঙ্গে উঠেছে মাত্র ঠিক সে সময়ই অঘটনটি ঘটলো। হঠাৎ ভয়ানক দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করলো রেডিও সিগন্যাল গ্রহণকারী স্পূলগুলো। অবাক হয়ে নাহিদ সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলে উঠলো, খুব আশ্চর্য ব্যাপার তো! এমনটি তো কখনও ঘটতে দেখেনি।
- কি হয়েছে রে? জোসেফ কোন কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করে।
- অদ্ভুত দ্রুত গতির একটি রেডিও টেলিস্কোপিক সিগন্যাল আসছে অ্যান্ড্রোমিডা নেব্যুলার কাছাকাছি কোথাও থেকে। ঠিক এমন সময়টায় স্পূলগুলো আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। এবার নাহিদ আরও অবাক হয়ে গেল। কারণ স্পূলের সম্পূর্ণটি শেষ হয়েছে মাত্র ১৫ মিনিটে। (চলবে)