সাম্প্রতিক প্রকাশনা

ঢাকাবাসী, আপনারা আতশবাজি, পটকা ফোটানো এবং ফানুস উড়ানোর সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসুন

আলতামাস পাশা লেখাটি পড়েছেন 1963 জন পাঠক।
 ঢাকাবাসী আপনারা আতশবাজি, পটকা ফোটানো এবং ফানুস উড়ানোর সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসুন।
এবারও ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ রাত ১২ টার পর খ্রীস্টিয় নববর্ষ  ২০২৪ উদযাপনকালে ঢাকা নগরীতে বিভিন্ন ধরনের আতশবাজি বা পটকা ফোটানো এবং ফানুস উড়ানো হবে। প্রতিবার এবিষয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকে। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টো চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে। প্রায় টানা ৪/৫ ঘন্টা ব্যাপী আতশবাজি বা পটকা ফোটানো এবং ফানুস উড়ানোতে ব্যস্ত থাকে কিছু উৎশৃঙ্খল তরুণ-তরুণী। কেউ তাদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি বা চেষ্টা করেনি কখনও।

ঢাকা শহরের বেশ কিছু স্থানে ফানুস থেকে আগুনও লাগে। চলতি বছরে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ছিল ঢাকার মেট্রোরেলে বৈদ্যুত্যিক তারের ফানুস এসে আটকে যাওয়াতে প্রায় দু’ঘন্টা এই স্থাপনা নিরাপত্তার জন্য বন্ধ রাখা হয়। পরে ফানুস অপসারিত হলে তা আবার চালু হয়। দেশের এই কেপিআই স্থাপনায় যদি ফানুস থেকে কোনো ভাবে আগুন লাগতো তা’হলে সে দায়ভার কে বহন করতো? এক বছরেও তার কোন সুরাহা হয়নি। হবে বলেও মনে হয় না।
এখন শীতকাল। গায়ে হলুদ আর বিয়ের মৌসুম। এখানেও থেমে নেই আতশবাজির জয়জয়কার। সন্ধ্যা-রাত্রি হলেই মাইকে ভীনদেশী গান বাজে উচ্চ ভলিউমে। তারপর শুরু হয়  আতশবাজির ভয়াবহ শব্দ। শব্দদূষণে শহর  এলাকায় পাখি, কিটপতঙ্গ হতচকিত হয়, এমনি কি মারা পর্যন্ত যায়। ডিমের ভিতরে থাকা তাদের ভ্রুণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঢাকা শহরে কুকুর-বিড়ালদের ভালমন্দ নিয়ে অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু রাস্তার কুকুর-বিড়ালের জন্য একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কি আজও নিশ্চিত করা গেছে? আতশবাজি, পটকা ফোটানোর শব্দদূষণে এসকল রাস্তার কুকুর-বিড়ালের জীবনাচারণে কি কি ধরনের পরিবর্তন ঘটে তার ওপর কোন গবেষণা করা হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষসহ সবধরনের প্রাণীর মাঝেই এর বিশাল ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।

ইউনিসেফ বলছে  এ থেকে প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে,
‘ভীতি ও উদ্বেগের অনুভূতি যা হঠাৎ করেই আমাদের হতবিহ্বল করে দিতে পারে এবং সাধারণত এর সঙ্গে হালকা মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার মতো তীব্র শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক শিশু আতঙ্কঅনুভব করে, যেমন সে মনে করতে পারে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। এমনকি যখন প্রকৃতপক্ষে কোনো বিপদ থাকে না, তখনও এই অনুভূতি হতে পারে’।

বিজ্ঞানীদের মতে, একটি আতশবাজিতে ৭৫ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ১৫ শতাংশ চারকোল এবং ১০ শতাংশ পর্যন্ত সালফার থাকতে পারে। এগুলোর প্রত্যেকটিই পরিবেশের জন্য খুব ক্ষতিকর। তাছাড়া বিকট শব্দ, তীব্র আলোর ঝলকানি এবং এর সঙ্গে যে পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক কণা বাতাসে ছড়ায় তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলোর প্রত্যেকটিই পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

বিজ্ঞানীরা আরো জানাচ্ছেন, বাজি-পটকার মধ্যে থাকে সহজদাহ্য মিশ্রণ। যা বাতাসের সাহায্য ছাড়াই জ্বলতে পারে। এজন্য প্রধানত ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম ক্লোরেট বা নাইট্রেট অথবা সোডিয়াম নাইট্রেট। এছাড়া দাহ্যপদার্থ হিসেবে থাকে কাঠ-কয়লার গুঁড়ো, সালফার বা গন্ধক ইত্যাদি। আগুন লাগলে, পটাশিয়াম ক্লোরেট থেকে প্রচুর অক্সিজেন বেরিয়ে আসে। আর তারই সাহায্যে অন্য পদার্থগুলো জ্বলতে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে ফোর্বস পত্রিকার এক প্রতিবেদনেও আতশবাজির ভয়াবহতা উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আতশবাজির কণাগুলো ধাতুর লবণের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শুধু যে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তা নয়, এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে চিহ্নিত কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেনযুক্ত গ্যাস তৈরি হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলোর অন্যতম। এই গ্যাস এবং ধাতুযুক্ত কণাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে খুব দ্রুত ফুসফুস এবং রক্তে মিশে যেতে পারে। ফলস্বরূপ তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটে।

অন্যদিকে, আতশবাজির সময় যে ভয়াবহ শব্দ তৈরি হয়, তা শুধু যে নারী, শিশু আর বয়স্কদেরই শ্রুবণ ইন্দ্রিয় বা হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে তাই নয়, বরং প্রাণিজগতে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। বিশেষ করে গভীর রাতে যখন প্রাণিরা ঘুমিয়ে থাকে তখন অকস্মাৎ বিকট শব্দ তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠে। অন্যদিকে, শব্দবাজির মতো আলোর বাজিও দূষণ ছড়ায়। যে কোন আতশ বাজিই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। বাজির বিষাক্ত ধোঁয়ায় করোনা বা অন্যান্য শ্বাসজণীত রোগে আক্রান্তদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইংরেজি নববর্ষ পালনের সময় পটকাবাজিতে ইতালির রোমের প্রধান রেলস্টেশনে কয়েকশ স্টারলিংস পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আহত হয় বহু পাখি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব প্রোটেকশন অব অ্যানিমেলস (ওআইপিএ) একে ‘হত্যাকাণ্ড’ আখ্যা দেয়। তারা পাখিদের মৃত্যুর জন্য উচ্চশব্দে পটকাবাজি ফোটানো ও আতশবাজিকেই দায়ি করে।

বিগত ২০২০ সালে নববর্ষ উদযাপনের জন্য উড়ানো ফানুস থেকে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে ক্রেফেল্ড শহরে এক চিড়িয়াখানায় আগুন লেগে যায়। এতে গরিলা, ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জিসহ অন্তত ৩০টি বন্যপ্রাণী পুড়ে যায়। পুলিশ জানায়, বর্ষবরণের কিছু আগে ফানুস থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ফেসবুকে জানায়, সবচেয়ে ভীতিকর আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। বানরদের খাঁচায় কোনো প্রাণী বেঁচে নেই। নিরাপত্তার আশঙ্কায় আগে থেকেই কংমিং নামে পরিচিত চাইনিজ ফানুস শহরটিতে নিষিদ্ধ। তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই এসব ফানুস উড়ানো হয়।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ করার পরও থামছে না আতসবাজি ফোটানো। এতে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটছে। বিকট শব্দ আর আলোর ঝলকানির প্রভাব পড়ছে প্রাণিজগতেও। সম্প্রতি থার্টি ফার্স্ট নাইটে মিরপুরের এক বাড়িতে একটি ফানুস আকাশ থেকে এসে পড়ে। এতে আগুন ধরে যায় বাড়ির টিনের চালে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ফানুস ওড়ানো হয়। এতে যেকোনো সময় আগুন লাগতে পারে। ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায়  ফানুস ওড়ানো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে পুরান ঢাকায় মনস্টার, ফায়ার ওয়ার্কস, ড্রিম নাইট, আতশবাজি ও ফানুস নামে ফেসবুক পেজ ওপেন করে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মালিকের দেয়া তথ্যমতে, বিগত ২০২০ সালে শুধুমাত্র ৩১ ডিসেম্বর একদিনেই অনলাইনের মাধ্যমে আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি করেছেন ৪০ লাখ টাকার উপরে। এক সপ্তাহে বিক্রি করেছেন অন্তত ৩ কোটি টাকা। 
বিক্রেতাদের দেয়া তথ্যমতে, কমান্ডো ব্র্যান্ডের একটি আতশবাজি বিক্রি হয় ৫৫০ টাকায়। তবে ৩১ ডিসেম্বর দাম বেড়ে হয় ৯০০ টাকা পর্যন্ত। অন্যান্য ব্র্যান্ডের আতশবাজিও বিক্রি হয় কয়েকগুণ দামে। বিক্রেতাদের হিসেবে শুধু পুরান ঢাকাতেই ৩০ হাজার বাড়ি আছে। প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ১০ হাজার টাকা করে বাজেট রাখলেও প্রায় ত্রিশ কোটি টাকার আতশবাজিতে ব্যয় হয়। সারাদেশে আতশবাজির হিসাব ধরলে শত কোটি টাকার বাজার ধরা যায়।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আতশবাজি আমদানি করতে পারবে। এর বাইরে আতশবাজি আমদানি, ব্যবহার ও মজুদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষিত। তবে এর মধ্যেও যারা আতশবাজি বিক্রি করছেন তারা চোরাইপথে অথবা অবৈধভাবে আনছেন।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ধীর পদক্ষেপে মানবসভ্যতার দিকে এগিয়ে আসছে জলবায়ু পরিবর্তনের মহাবিপর্যয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ গ্রিনহাউজ গ্যাস বেড়ে চলেছে। দিন দিন উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠছে পৃথিবী। গলছে দুই মেরুর বরফ। বাড়ছে সমুদ্র তলের উচ্চতা। তলিয়ে যাচ্ছে বহু নিম্নভূমি। এমন পরিস্থিতিতে শুধু আনন্দের জন্য, উল্লাসের জন্য পরিবেশবিরোধী কোনো কিছুই করা যাবে না। সেজন্য পরিবেশবান্ধব আতশবাজি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। আসন্ন নববর্ষ উদযাপনে আতশবাজি ও পটকা –ককটেল ব্যবহারে নগরবাসীকে সচেতন হতে হলেই হবে না এর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে তৎপর হতে হবে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

যেকোনো উৎসব আপনি পালন করতেই পারেন। কিন্তু তা যেনো আপনার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে করতে না হয়। আপনার নিজের আনন্দ যদি অন্যের বিরক্তির বা আতংকের কারণ হয় তবে তা অবশ্যই বর্জনীয়। আতশবাজি ও পটকা –ককটেল ফোটানো শিশু বা দুর্বল চিত্র মানুষের মধ্যে প্যানিক অ্যাটাকের সৃষ্টি করতে পারে। হার্টের রোগীও প্রচণ্ড শব্দে আতশবাজি ও পটকা –ককটেল বিস্ফোরণে আতংকগ্রস্থ হয়ে মারা পর্যন্ত যেতে পারে।তাই আসুন সময় থাকতে আমরা পরিবার, মহল্লা, শহর বা গ্রাম সব জায়গায় সচেতন হই পরিবেশকে মানুষসহ সব প্রাণীর জন্য নির্মল রাখি।

পাঠকের মন্তব্য


একই ধরনের লেখা, আপনার পছন্দ হতে পারে

bdjogajog